Wednesday, July 22, 2009

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা

শহীদ কাদরী

ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।

ভয় নেই...আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!


সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।

ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।

ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।

কেন যেতে চাই

শহীদ কাদরী

আমি তোমাদেররই দিকে যেতে চাই
ঝকঝকে নতুন একটি সেতু
যেমন নদীর পাড়ে দাঁড়ানো ঐ লোকগুলোর কাছে পৌছে যেতে চায়
কিন্তু তামা ও পিতলসহ বাসন-কোসন,চিড়ে-গুড় ইত্যাদি গোছাতে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড ব্যস্ত।

মাঝে মাঝে দূর থেকে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তোমাদের ব্যস্ততা দেখতে
ভালবাসি।

সমুদ্র তরঙ্গগুলো সমুদ্রকে নিয়ে এ্যাতো ব্যস্ত নয়,
অরণ্যের অভ্যন্তরে ক্ষুধার্ত,স্বাধীন বাঘ হরিণের জন্য এ্যাতো
ব্যস্ত নয়,
দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রেমিকের হাত ব্রেসিয়ারের ভেতর এ্যাতো
ব্যস্ত নয়,

আমি তোমাদেররই দিকে যেতে চাই
শীতের পর প্রথম উল্টাপাল্টা বাতাস যেমন
প্রত্যেকটি ফাঁক-ফোকর এবং রন্ধ্র দিয়ে যেতে চায় তোমাদের
চোখে-মুখে-চুলে
কিন্তু তৈজসপত্র রঙ,টেবিল চেয়ারের ঢঙ,জানালার পর্দা
ইত্যাদি
বদলাতে,গোছগাছ করতে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড বেশি ব্যস্ত।

ক্বচিৎ-কখনো খুব কাছ থেকে তোমাদের প্রচন্ড ব্যস্ততা আমি দেখি,
দিগন্ত আঁধার-করা সজল শ্রাবণও বৃষ্টি ঝরানোর জন্য
অমন ব্যস্ত নয়,
তাক-করা রাইফেলের অমোঘ রেন্জ থেকে উড়ে পালানোর জন্য
হরিয়ালের ঝাঁকও অমন ব্যস্ত নয়,
কর্কট-রোগীর দেহে ক্যান্সারের কোষগুলো ছড়িয়ে পড়ার জন্য
অমন ব্যস্ত নয়,

আমি তো তোমাদেরই দিকে যেতে চাই
ইন্দ্রনীল একটি মোহন আংটি
প্রেমিকের কম্পমান হাত থেকে প্রেমিকার আঙ্গুলে যেমন
উঠে যেতে চায়,
কিন্তু চাষাবাদ,বানিজ্য এবং প্রতিযোগিতামূলক শিল্প
ইত্যাদি বিষয় নিয়ে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড বেশি ব্যস্ত।

হরিণ-হননকারী ব্যাধের মাংসল মুঠো থেকে ছুটে-যাওয়া
বল্লমের মতো তোমরা ব্যস্ত
দিগভ্রান্ত তৃষ্ণার্ত পথিককে গিলে ফেলার জন্য উত্তর বাংলার
চোরাবালির মতো তোমরা ব্যস্ত
চিরচেনা বৃক্ষরাজিকে পল্লবশূন্য করার জন্য শীতের জটিল
বিস্তারের মতো তোমরা ব্যস্ত
যাত্রী নিয়ে ঘর-ফেরা নৌকাগুলো হরণ করার জন্য চোরাস্রোত
এবং ঘূর্ণিপাকের মতো তোমরা ব্যস্ত

তোমরা ব্যস্ত,তোমরা ব্যস্ত,তোমরা ব্যস্ত
তোমারা বড্ড বেশি ব্যস্ত
অথচ আমি তো আজীবন তোমাদেরই দিকে যেতে চাই।
কেন যেতে চাই!

Tuesday, July 21, 2009

একটি উত্থান-পতনের গল্প

শহীদ কাদরী

আমার বাবা প্রথমে ছিলেন একজন
শিক্ষিত সংস্কৃতিবান সম্পাদক
তারপর হলেন এক
জাঁদরেল অফিসার ;
তিনি স্বপ্নের ভেতর
টাকা নিয়ে লোফালুফি খেলতেন
টাকা নিয়ে ,
আমি তাঁর ছেলে প্রথমে হলাম বেকার ,
তারপর বেল্লিক
তারপরো বেকুব
এখন লিখি কবিতা
আমি স্বপ্নের ভেতর
নক্ষত্র নিয়ে লোফালুফি করি
নক্ষত্র নিয়ে ;
বাবা ছিলেন উজ্জ্বল,ধবধবে ফর্শা
এবং ছয়ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা
আমি তাঁর ছেলে-ময়লা,রোদে-পোড়া,কালো
৫ ফুট ৯ ইঞ্চি মোটে(অর্থাৎ
পাঁচ ইঞ্চি বেঁটে)
বাবা উন্নত-নাসা
পরতেন প্যাঁনসে
আমার নাকই নেই বলতে গেলে
পরি হ্যান্ডেল-অলা চশমা
বাবা জানতেন দুর্দান্ত ইংরিজি
আমি অল্পস্বল্প বাংলা
বাবা যখন-তখন যাকে-তাকে চপেটাঘাত করতে পারতেন ।
আমি কেবল মাঝে-মধ্যে একে-ওকে চুম্বন ছুঁড়ে মারতে পারি ,ব্যাস !
প্রবল বর্ষার দিনে বাবা
রাস্তায় জলোচ্ছ্বাস তুলে স্টুডিবেকারে ঘরে ফিরতেন,
আমি পাতলুন গুটিয়ে স্যান্ডেল হাতে
অনেক খানাখন্দে পা রেখে এভিনিউ পার হ'তে চেষ্টা করি
বাবার নাম খালেদ-ইবনে-আহমাদ কাদরী
যেন দামেস্কে তৈরী কারুকাজ-করা একটি বিশাল ভারী তরবারী,
যেন বৃটিশ আমলের এখনও-নির্ভরযোগ্য কোনো
ঝনঝন ক'রে-ওঠা ওভারব্রীজ ,
আমার নাম খুব হ্রস্ব
আমার নাম শহীদ কাদরী
ছোটো,বেঁটে - ঝোড়ো নদীতে
কাগজের নৌকার মতই পলকা
কাগজের নৌকার মতই পলকা ।

প্রেম

শহীদ কাদরী
We must love one another or die- W.H Auden

না,প্রেম সে কোনো ছিপছিপে নৌকা নয়-
যার চোখ,মুখ,নাক ঠুকরে খাবে
তলোয়ার- মাছের দঙ্গল,সুগভীর জলের জঙ্গলে
সমুদ্রচারীর বাঁকা দাঁতের জন্যে যে উঠেছে বেড়ে,
তাকে,হ্যাঁ,তাকে কেবল জিজ্ঞেস ক'রো,সেই বলবে
না,প্রেম সে কোনো ছিপছিপে নৌকা নয়,
ভেঙে-আসা জাহাজের পাটাতন নয়,দারুচিনি দ্বীপ নয়,
দীপ্র বাহুর সাঁতার নয়; খড়খুটো? তা-ও নয়।
ঝোড়ো রাতে পুরোনো আটাচালার কিংবা প্রবল বৃষ্টিতে
কোনো এক গাড়ি বারান্দার ছাঁট-লাগা আশ্রয়টুকুও নয়,
ফুসফুসের ভেতর যদি পোকা-মাকড় গুন্জন ক'রে ওঠে
না,প্রেম তখন আর শুশ্রূষাও নয়; সর্বদা,সর্বত্র
পরাস্ত সে; মৃত প্রেমিকের ঠান্ডা হাত ধ'রে
সে বড়ো বিহ্বল,হাঁটু ভেঙে- পড়া কাতর মানুষ।
মাথার খুলির মধ্যে যখন গভীর গূঢ় বেদনার
চোরাস্রোত হীরকের ধারালো- ছটার মতো
ব'য়ে যায়,বড়ো তাৎপর্যহীন হ'য়ে ওঠে আমাদের
ঊরুর উত্থান,উদ্যত শিশ্নের লাফ,স্তনের গঠন।

মাঝে মাঝে মনে হয় শীতরাতে শুধু কম্বলের জন্যে,
দুটো চাপাতি এবং সামান্য শব্জীর জন্যে
কিংবা একটু শান্তির আকাঙ্খায়,কেবল স্বস্তির জন্যে
বেদনার অবসান চেয়ে তোমাকে হয়তো কিছু বর্বরের কাছে
অনায়াসে বিক্রি ক'রে দিতে পারি-অবশ্যই পারি।
কিন্তু এখন,এই মুহূর্ত, এই স্বীকারোক্তির পর মনে হলো:
হয়তো বা আমি তা পারি না-হয়তো আমি তা পারবো না।

'সঙ্গতি'

শহীদ কাদরী

বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ।
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না,পাবে না,পাবে না.......

একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুন্জের মতো,
পুরনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না,পাবে না,পাবে না.......

ব্যারাকে ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ
ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,
গামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলি গানের-তোমরা দু'জন একঘরে পাবে ঠাঁই

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না,পাবে না,পাবে না.......

আজ সারাদিন

শহীদ কাদরী

বাতাস আমাকে লম্বা হাত বাড়িয়ে
চুলের ঝুঁটি ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে আজ সারাদিন
কয়েকটা লতাপাতা নিয়ে
বিদঘুটে বাতাস,
হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে আমাকে,
লাল পাগড়ি-পরা পুলিশের মত কৃষ্ণচূড়া
হেঁকে বললো :
'তুমি বন্দী' !

আজ সকাল থেকে একজোড়া শালিক
গোয়েন্দার মতো ঘুরছে
যেন এভিনিউ পার হ'য়ে নির্জন সড়কে
পা রাখলেই আমাকে গ্রেপ্তার ক'রে নিয়ে যাবে ঠিক !

'তুমি অপরাধী'
-এই কথা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যেন
ব'লে গেল বজ্রসহ এক পশলা হঠাৎ বৃষ্টিপাত-
'তুমি অপরাধী'-
মানুষের মুখের আদলে গড়া একটি গোলাপের কাছে।'

বৃষ্টিভেজা একটি কালো কাক
একটি কম্পমান আধ-ভাঙা ডালের ওপর থেকে
কিছুটা কাতর আর কিছুটা কর্কশ গলায়
আবার ব'লে উঠলো: তুমি অপরাধী!

আজ সারাদিন বাতাস,বৃষ্টি আর শালিক
আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো
এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত
তোমার বাড়ির
কিন্নরকন্ঠ নদী অবধি আমি গেলাম
কিন্তু সেখানে ঘাটের উপর একটি প্রাচীন বুড়ি
সোনার ছাই দিয়ে ঘটি-বাটি মেজে চলেছে আপন মনে।
একটা সাংঘাতিক সূক্ষ ধ্বনি শুয়ে আছে
পিরিচে,পেয়ালায়।

ঐ বাজনা শুনতে নেই
ঐ বাজনা নৌকার পাল খুলে নেয়
ঐ বাজনা ষ্টীমারকে ডাঙার ওপর আছড়ে ফ্যালে
ঐ বাজনা গ্রাস করে প্রেম,স্মৃতি,শস্য,শয্যা,ও গৃহ

তোমার বাড়ির
কিন্নরকন্ঠ নদী অবধি আমি গিয়েছিলাম।
কিন্তু হাতভর্তি শালিকের পালক
আর চুলের মধ্যে এলোপাথারি বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে
উল্টোপাল্টা পা ফেলে
তোমার দরজা পর্যন্ত যেতে ইচ্ছে হল না।

ঐ শালিকের ভেতর উনুনের আভা,মশলার ঘ্রাণ।
তোমার চিবুক,রুটি আর লালচে চুলের গন্ধ,
ঐ বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে পাতা আছে তোমার
বারান্দার চেয়ারগুলো
তাহলে তোমার কাছে গিয়ে আর কি হবে!

আজ একজোড়া শালিক
গোয়েন্দা পুলিশের মতো
বাতাস একটা বুনো একরোখা মোষের মতো
আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত

আমি অনেকদিন পর একজন হা-ঘরে
উদ্বাস্তু হ'য়ে চরকির মতো গোটা শহর ঘুরে বেড়ালাম।

Sunday, July 19, 2009

দুর থেকে দেখো

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

আমি আমার ভাবনাগুলোকে
চামচে করে নাড়াতে থাকব-
অন্য কোন টেবিল থেকে তুমি শুনো।

সামনে দাঁড় করানো থাকবে কাপ
আমার কোলের ওপর দুটো আঙ্গুল
কুরুশকাঠির মতো বুনবে
স্মৃতির জাল-
তুমি অন্য কোন টেবিল থেকে দেখো।

তারপর
যখন জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে সময়
চেয়ারে শব্দ করে আমি উঠে পড়ব
পেছনে একবারও না তাকিয়ে
আমি চলে যাব
যেখানে বাড়িগুলোর গায়ে
চাবুক মারছে বিদ্যুৎ
যেখানে গাছগুলোকে চুলের মুঠি ধরে
মাটিতে ফেলে দিতে চাইছে হাওয়া
যেখানে বদ্ধ জানালায় নখ আঁচড়াচ্ছে
হিংস্র বৃষ্টি।

তুমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখো।।

পায়ে পায়ে

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সারাক্ষণ
সে আমার পায়ে পায়ে
সারাক্ষণ
পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করে।

তাকে বলি; তোমাকে নিয়ে থাকার
সময় নেই-
হে বিষাদ,তুমি যাও
এখন সময় নেই
তুমি যাও।
গাছের গুঁড়িতে বুক-পিট এক করে
যৌবনে পা দিয়ে রয়েছে
একটি উলঙ্গ মৃত্যু-
আমি এখুনি দেখে আসছি:

পৃথিবীতে গাঁক গাঁক করে ফিরছে
যে দাঁত-খিঁচানো ভয়,
আমি তার গায়ের চামড়াটা
খুলে নিতে চাই।
চেয়ে দেখ হে বিষাদ-
একটু সুখের মুখ দেখবে বলে
আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে
চুল সাদা করে আহাম্মদের মা।

হে বিষাদ,
তুমি আমার হাতের কাছ থেকে সরে যাও
জল আর কাদায় ধান রুইতে হবে।
হে বিষাদ,
হাতের কাছ থেকে সরে যাও
আগাছাগুলো নিড়োতে হবে।

যায় না;
বিষাদ তবু যায় না।
সারাক্ষণ আমার পায়ে পায়ে
সারাক্ষণ
পায়ে পায়ে
ঘুরঘুর করে।

আমি রাগে অন্ধ হই
আমার বেদনাগুলো তার দিকে
ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারি।
বলি : শয়তান,তোকে যমে নিলে
আমি বাঁচি!

তারপর কখন কাজের মধ্যে ডুবে গিয়েছি জানি না-
চেয়ে দেখি
দূরে বসে সেই আমার বিষাদ
আমাকে একেবারে ভুলে গিয়ে
আমার অপূর্ণ বাসনাগুলো নিয়ে খেলছে।

হাসতে হাসতে আমি তাকে
দুরন্ত শিশুর মতো
কোলে তুলে নিই।।

ইলিশ

বুদ্ধদেব বসু

আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।

মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রানপনে ফেলে জাল,টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা,তারা খাদ্যহীন,খাদ্যের সম্বল।

রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে।এলো বর্ষা,ইলিশ -উৎসব।

আগুনের কাছে আগে

পূ্র্ণেন্দু পত্রী

হৃদয়ের কাছে আমি আগে কত গোলাপ চেয়েছি
এখন পাঁউরুটি চাই,সিমেন্টের পারমিট চাই।
সেই রমণীর কাছে আগে কত ভূ-স্বর্গ চেয়েছি
এখন দেশলাই চাই,হাতপাখা,জেলুসিল চাই।

আগুনের কাছে আগে মানুষেরা নতজানু ছিল
মানুষের সর্বোত্তম প্রার্থনার বিস্তীর্নতা ছিল;
আমাকে এমন জামা দাও তুমি,এমন পতাকা
হীরের আংটির মতো মূল্যবান এবং মহান।
আগুনের কাছে এসে এখন মানুষের করজোড়ে
ভোট চায়,কমিটির ডানলোপিলো-আঁটা গদি চায়
মহিষাসুরের নীল খড়গ চায়,অথবা পিস্তল।

মানুষ মেঘের কাছে আগে কত কবিতা চেয়েছে
এখন পেট্রোল চায়,প্রমোশন,পাসপোর্ট চায়।

কেরোসিনে,কখনো ক্রন্দনে

পূর্ণেন্দু পত্রী

জ্যোতির্ময় বিছানা তোমার
তুমি বৃক্ষে শুকাও চাদর
তোমার বালিশ থেকে তুলো
উড়ে আসে আশ্বিনে-অঘ্রাণে।

পশমের লেপ ও তোশক
মসৃণতা ভালোবাসো তুমি
আমাদের নখে বড় ধুলো
মাংসাসীর হাড়-কাঁটা দাঁতে।

তুমি সূর্য ঘোরাও আঙুলে
নক্ষত্র-শাওয়ারে করো স্নান
আমাদের হ্যারিকেন জ্বলে
কেরোসিনে,কখনো ক্রন্দনে।

স্বপ্নগুলি হ্যাঙ্গারে রয়েছে

পূর্ণেন্দু পত্রী

মুহুর্তের সার্থকতা মানুষের কাছে আজ
বড় বেশী প্রিয়।
জীবনের স্থাপত্যের উচ্চতা ও অভিপ্রায়মালা
ছেঁটে ছোট করে দিতে
চতুর্দিকে উগ্র হয়ে রয়েছে সেলুন।
মানুষের ভাঙা-চোরা ভুরুর উপরে
চাঁদের ফালির মতো
আজ কোন স্থির আলো নেই।
ছাতার দোকানে ছাতা যেরকম ঝোলে
সেইভাবে মানুষের রক্ত ও চন্দনমাখা স্বপ্নগুলি
হ্যাঙ্গারে রয়েছে।

Saturday, July 18, 2009

বসন্তকালেই

পূর্ণেন্দু পত্রী

শুনেছি বসন্তকালে বনভূমি অহঙ্কারী হয়।
অথচ আমার সব সোনাদানা চুরি হয়ে গেছে এই বসন্তকালেই।
বসন্তকালেই সেই কপোতাক্ষী রমণীর কুষ্ঠ হয়েছিল
যে আমাকে বলেছিল তার সব নদী,গিরি,অরণ্যের আমি অধীশ্বর।
খুদ-কুঁড়ো খুঁটে খাওয়া গরীবের ছিটেবেড়ো থেকে
তোমাদের মোজাইক বাগান পার্টিতে এসে ফলার খাওয়ার
সর্নিবন্ধ অনুরোধ এসেছিল বসন্তকালেই।

বসন্তকালেই আমি প্রধান অতিথি হয়ে পুরুলিয়া গেছি
বসন্তকালেই আমি ভুবনেশ্বর গিয়ে কবিতা পড়েছি
বসন্তকালেই আমি আকাশের ছেঁড়া জামা সেলাই করেছি।
অথচ আমার সব সোনাদানা,জমি-জমা,কাপড়-চোপড়
স্মৃতি দিয়ে মাজা-ঘষা গোপনতা,অমর পরাগ
এবং বেসরকারী অস্ত্রাগার থেকে লুঠ গোলা ও বারুদ
ভিজে,ভেঙে,গলে,পচে,খসে,ঝরে,নষ্ট হচ্ছে
বসন্তকালেই।

Wednesday, June 17, 2009

রূপাবলী

রূপাবলী
রণদীপম বসু

ভেতরে আমার সতেরোশ’ ডাহুক ডাকে
হতে পারে শুধুই সতেরো, অথবা সতেরো হাজার-
এমন নির্জনে এলে যার কথা মনে পড়ে খুব
যে আমার কষ্টের ক্ষরণ মুছে মুছে বাড়ায় কেবল
সেই তো সে রূপাবলী...
চেনা চেনা অক্ষরে এতো যে অচেনা সে-
নাম তার রেখেছিলাম ‘রূপাবলী দে’। #
(১৯৯৬)

[কাব্যগ্রন্থ: অদৃশ্য বাতিঘর]

Sunday, May 3, 2009

পরানের গহীন ভিতর

সৈয়দ শামসুল হক

জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচর আদিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি - একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুন বাজি,তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷

সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে

হুমায়ুন আজাদ

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চ'লে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ'লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল-
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চ'লে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ'লে যাবে শহর বন্দর ধানখেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ'লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।


আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-
মেধা; -এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।


আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ'লে যাবে,
কিশোরীরা চ'লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক'রে চ'লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক-
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।

মন ভালো নেই

মহাদেব সাহা

বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুল করে চলে যায়,এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকব শূণ্যতার দিকে?
এই শুন্য ঘরে, এই নির্বাসনে
কতোকাল,আর কতোকাল !
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেছে ক্যাকটাস -
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূণ্যতার এই দীর্ঘশাস, এই দীর্ঘ পদধনি।

টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙ্গা চেয়ারে একা বসে আছি।

এ কী শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা !
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই -
এই কি আমার অপরাধ !
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিলো -
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানোর কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূণ্যতা, শূণ্যতা ।
তোমার শূণ্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না -
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব,সারাদিন তুষারপাত...
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই ।

তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না

আবুল হাসান

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ' শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো; তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো
কালিমা রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
এখন তোমার কাছে যাবো
তোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা--
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো
আমি আঁধার রাখবো না!

এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভীর দুধের সাদা
হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত
যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না-- তোমার চিবুকে
তারা নিশ্চয়ই আছেন!

তোমার চিবুকে সেই গাভীর দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি
কাছে আয় পুরনো রাখাল!
আমি কাছে যাবো আমি তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না!

চতুর্দশপদী কবিতাবলী

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে...
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা--
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে ।

অবনী বাড়ি আছো

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

কুড়ি বছর পরে

জীবনানন্দ দাশ


আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি।
আবার বছর কুড়ি পরে—
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে—
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে— তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়— মাঠের ভিতরে।
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর;
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল।

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—
তখন হঠাৎ মেঠোপথে পাই আমি তোমারে আবার

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের— আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে।

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!

তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে—
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাঁকে
কোথায় লুকায় আপনাকে।
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে—

সোনালী-সোনালী চিল— শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে—
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে।

শীত রাত

জীবনানন্দ দাশ

এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।

শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে -
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।

এদিকে কোকিল ডাকছে - পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব’লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে।

সিংহ হুঙ্কার ক’রে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক - আফিমের সিংহ - অন্ধ - অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।

সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ’শে খ’শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ, - তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও

জীবনানন্দ দাশ

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে-একবার — দুইবার — তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;
দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ — শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে
শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে,

খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্‌ কাহিনীর দেশে –
‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,
কল্‌মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীরে –
নীরবে পা ধোয় জলে একবার — তারপর দূরে নিরুদ্দেশে
চ’লে যায় কুয়াশায় — তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে
হারাব না তারে আমি — সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।

কোনোদিন দেখিব না তারে আমি

জীবনানন্দ দাশ

কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান
সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান
পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে,
সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে,
যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান,
যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান,
ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে

জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে
বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে;
প্রতিটি নক্ষত্র তার স’ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে
অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।

যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়

জীবনানন্দ দাশ

যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়-সে তো আর ফিরে নাহি আসে:
কাঞ্চনমালা যে কবে ঝরে গেছে;-বনে আজো কলমীর ফুল
ফুটে যায়-সে তবু ফেরে না, হায়;-বিশালাক্ষ্মী: সেও তো রাতুল
চরণ মুছিয়া নিয়া চলে গেছে;-মাঝপথে জলের উচ্ছ্বাসে
বাধা পেয়ে নদীরা মজিয়া গেছে দিকে দিকে-শ্মশানের পাশে
আর তারা আসে নাকো; সুন্দরীর বনে বাঘ ভিজে জুল-জুল
চোখ তুলে চেয়ে থাকে-কতো পাটরানীদের গাঢ় এলোচুল
এই গৌড় বাংলায়-পড়ে আছে তাহার পায়ের তলে ঘাসে

জানে সে কি! দেখে নাকি তারাবনে পড়ে আছে বিচূর্ণ দেউল,
বিশুষ্ক পদ্মের দীঘি-ফোঁপড়া মহলা ঘাট, হাজার মহাল
মৃত সব রূপসীরা; বুকে আজ ভেরেন্ডার ফুলে ভীমরুল
গান গায়-পাশ দিয়ে খল্‌ খল্‌ খল্‌ খল্‌ বয়ে যায় খাল,
তবু ঘুম ভাঙে নাকো-একবার ঘুমালে কে উঠে আসে আর
যদিও ডুকারি যায় শঙ্খচিল-মর্মরিয়া মরে গো মাদার।

যদি আমি ঝরে যাই একদিন

জীবনানন্দ দাশ

যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,
যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুজে,
যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়,
যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,
শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-
তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,
ঠেস্‌ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,

তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান-
যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড়
একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর,
যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;-
কবে যে আসিবে মৃত্যু; বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান-
রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে ম্লান

আবার আসিব ফিরে

জীবনানন্দ দাশ

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙা রায় — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে –

একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে

জীবনানন্দ দাশ

একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে
বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে রবো-পশমের মতো লাল ফুল
ঝরিবে বিজন ঘাসে, বাঁকা চাঁদ জেগে রবে,-নদীটির জল
বাঙারি মেয়ের মতো বিশালাক্ষ্মী মন্দিরের ধূসর কঁপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে-ভয়ে- তারপর সে ভাঙা ঘাটে
রূপসীরা আজ আর আসে নাকো পাট শুধু পচে অবিরল,
সেইখানে কলমীর দামে বেঁধে প্রেতিনীর মতন কেবল
কাঁদিবে সে সারা রাত,-দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে

সাজায়ে রেখেছে চিতা,-বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে রবে, ভিজে পেঁচা শান- স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে
শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প- ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে,
চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি-শাদা শাঁখা- বাংলার ঘাস
আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ- আপনার মনে
ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;-চারিদিকে এই সব আশ্বর্য উচ্ছ্বাস-

অচল প্রেমের পদ্য

হেলাল হাফিজ

০১
আছি।
বড্ড জানান দিতে ইচ্ছে করে, - আছি,
মনে ও মগজে
গুন্‌ গুন্‌ করে
প্রণয়ের মৌমাছি।

০২
কোনদিন, আচমকা একদিন
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,-
‘চলো যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই’,
যাবে?

০৩
তোমার জন্য সকাল, দুপুর
তোমার জন্য সন্ধ্যা
তোমার জন্য সকল গোলাপ
এবং রজনীগন্ধা।

০৪
ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’
মন না দিলে
ছোবল দিও তুলে বিষের ফনা।

০৫
তোমার হাতে দিয়েছিলাম অথৈ সম্ভাবনা
তুমি কি আর অসাধারণ? তোমার যে যন্ত্রনা
খুব মামুলী, বেশ করেছো চতুর সুদর্শনা
আমার সাথে চুকিয়ে ফেলে চিকন বিড়ম্বনা

০৬
যদি যেতে চাও, যাও
আমি পথ হবো চরণের তলে
না ছুঁয়ে তোমাকে ছোঁব
ফেরাবো না, পোড়াবোই হিমেল অনলে।

০৭
আমাকে উস্টা মেরে দিব্যি যাচ্ছো চলে,
দেখি দেখি
বাঁ পায়ের চারু নখে চোট লাগেনি তো;
ইস্‌! করছো কি? বসো না লক্ষ্মীটি,
ক্ষমার রুমালে মুছে সজীব ক্ষতেই
এন্টিসেপটিক দুটো চুমু দিয়ে দেই।

০৮
তুমি কি জুলেখা, শিরী, সাবিত্রী, নাকি রজকিনী?
চিনি, খুব জানি
তুমি যার তার, যে কেউ তোমার,
তোমাকে দিলাম না - ভালোবাসার অপূর্ব অধিকার।

০৯
আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে
মানুষের কাছে এওতো আমার এক ধরনের ঝণ।
এমনই কপাল আমার
অপরিশোধ্য এই ঝণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

১০
হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি
নয় তো গিয়েছি হেরে
থাক না ধ্রুপদী অস্পষ্টতা
কে কাকে গেলাম ছেড়ে।

মন ভালো নেই

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না
সকলি গোপন
মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু
চোখ বুজে আছি
কে তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে
দিন কেটে যায়
আশায় আশায় আশায় আশায়

এখন আমার
ওষ্ঠে লাগে না
কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী
এমনকি নারী
এমনকি নারী
এমন কি সুরা এমন কি ভাষা

মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
বিকেল বেলায়
একলা একলা
পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে

কিছুই খুঁজি না
কোথাও যাই না
কাউকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ
আমার কী আছে
অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে
বীজের ভিতরে
ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন

মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে
দিন কেটে যায়
আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়

যদি নির্বাসন দাও

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো!
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নিনির্মেষ-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।

ধানক্ষেতে চাপ চাপ রক্ত
এইখানে ঝরেছিল মানুষের ঘাম
এখনো স্নানের আগে কেউ কেউ করে থাকে নদীকে প্রণাম
এখনো নদীর বুকে
মোচার খোলায় ঘোরে

লুঠেরা, ফেরারী!
শহরে বন্দরে এত অগ্নি বৃষ্টি
বৃষ্টিতে চিক্কণ তবু এক একটি অপরূপ ভোর
বাজারে ক্রুরতা, গ্রামে রণহিংসা
বাতাবি লেবুর গাছে জোনাকির ঝিকমিক খেলা
বিশাল প্রাসাদে বসে কাপুরুষতার মেলা
বুলেট ও বিস্ফোরণ
শঠ তঞ্চকের এত ছদ্মবেশ
রাত্রির শিশিরে কাঁপে ঘাস ফুল-
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।

কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দিঘির পাড়ে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?
আমি কি দেখিনি কোনো মন্থর বিকেলে
শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি?
মোষের ঘাড়ের মত পরিশ্রমী মানুষের পাশে
শিউলি ফুলের মত বালিকার হাসি
নিইনি কি খেজুর রসের ঘ্রাণ
শুনিনি কি দুপুরে চিলের
তীক্ষ স্বর?
বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ…
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো।

মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস

মহাদেব সাহা

কেউ জানেনা একেকেটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষন্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!

দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল আর কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর আর তুষারবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়, কেউ জানে না
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষন্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।

তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;

মানুষের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুষ তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়, হায়, কেউ জানে না!

কথোপকথন - ৪

পূর্ণেন্দু পত্রী

- যে কোন একটা ফুলের নাম বল
- দুঃখ ।
- যে কোন একটা নদীর নাম বল
- বেদনা ।
- যে কোন একটা গাছের নাম বল
- দীর্ঘশ্বাস ।
- যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল
- অশ্রু ।
- এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
- বলো ।
- খুব সুখী হবে জীবনে ।
শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগুতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
- সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
- না ।
- তবে ?
- স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।

হুলিয়া

নির্মলেন্দু গুণ

আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে৷

কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে
আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম, একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই
আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে
কাঁধে হাত রেখে চিত্কার করে উঠেছিল;- আমি সবাইকে
মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি৷
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, মুখোমুখি বসে দূর থেকে
বারবার চেয়ে দেখলেন-, কিন্তু চিনতে পারলেন না৷

বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,
অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
রফিজ আমাকে চিনলো না৷
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি৷
সেই একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে
গ্রামে ফেরা, আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি৷

আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া৷
অনেক বদলে গেছে বাড়িটা,
টিনের চাল থেকে শুরু করে পুকুরের জল,
ফুলের বাগান থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;
চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনখানে৷

পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে
একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো৷
স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চতুর্দিকে ঘাস, জঙ্গল,
গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে; যেন সবখানেই
সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি৷
একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,
আমাকে দেখেই পালালো একজন, একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে
আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো- যেন পুলিশ-সমেত চেকার
তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল৷
হাঁটতে- হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,
অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া অশোক,
একসময়ে কী ভীষন ছায়া দিতো এই গাছটা;
অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়৷
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম৷
সেই বাসন্তী, আহা, সেই বাসন্তী এখন বিহারে,
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার- সন্তানের জননী হয়েছে৷

পুকুরের জলে শব্দ উঠলো মাছের, আবার জিভ দেখালো সাপ,
শান্ত-স্থির-বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে
একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে - -৷
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম,— “মা’৷
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো৷
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম৷

মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে
লুকিয়ে রেখে অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে
পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন; আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম,
দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল,
সেখানে লেনিন, বাবার জমা- খরচের পাশে কার্ল মার্কস;
আলমিরার একটি ভাঙ্গা- কাচের অভাব পূরণ করছে
ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি৷

মা পুকুর থেকে ফিরছেন, সন্ধ্যায় মহকুমা শহর থেকে
ফিরবেন বাবা, তাঁর পিঠে সংসারের ব্যাগ ঝুলবে তেমনি৷
সেনবাড়ি থেকে খবর পেয়ে বৌদি আসবেন,
পুনর্বার বিয়ে করতে অনুরোধ করবেন আমাকে৷
খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,
তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য৷
রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস৷
ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:
– আমাদের ভবিষ্যত্ কী?
– আইয়ুব খান এখন কোথায়?
– শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?
– আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?

আমি কিছুই বলবো না৷
আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকা সারি সারি চোখের ভিতরে
বাংলার বিভিন্ন ভবিষ্য়্ত্কে চেয়ে চেয়ে দেখবো৷
উত্কন্ঠিত চোখে চোখে নামবে কালো অন্ধকার, আমি চিত্কার করে
কন্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলবো:
‘আমি এসবের কিছুই জানি না,
আমি এসবের কিছুই বুঝি না৷’

ফুলদানি

নির্মলেন্দু গুণ

যেকোনো বাগান থেকে যেটা ইচ্ছে সেই ফুল,
যেকোনো সময় আমি তুলে নিয়ে যদি কভু
তোমার খোঁপায়, আহা, অজগর তোমার খোঁপায়
সাজাবার সুজোগ পেতাম–; তাহলে দেখতে লীলা,
তোমার শরীর ছুঁয়ে লাবণ্যের লোভন ফুলেরা
উদ্বেল হৃদয়ে নিত্য বিপর্যস্ত হতো, মত্ত মমতায়
বলতো আশ্চর্য হয়ে, হতো বলতেইঃ
‘খোঁপার মতন কোনো ফুলদানি নেই৷’

আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো

মহাদেব সাহা

আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো

এখানে মানুষ থাকে, এই নির্দয় নিষ্প্রাণ দেশে,
এই লৌহপুরীতে?
এই শহরের ভিড়ে পাখিদের ওড়াউড়ি নেই,
গাভীর হাম্বা রব কখনো শুনি না;
শুধু অচেনা মানুষের কোলাহল, গাড়ির কর্কশ শব্দ

বাড়ির উঠানে এখানে ওঠে না চাঁদ, নদীময় তারাভরা
দেখি না আকাশ
জুড়ায় না ক্লান্ত দেহ দখিনা বাতাস

এখানে মানুষেরা এক সাথে হেঁটে যায় কেই কাউকে চেনে না, মানুষ
এখানে থাকে?
ঢের হয়েছে বিদ্যা, ঢের হয়েছে প্রাপ্তি, তবু যেটুকু জীবন
আছে, বুকে নিয়ে
এবার আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো, গলা
ছেড়ে ডাকবো বাহার কাকা,
কানু ভাই তোমরা কোথায়?
ছি, এখানে মানুষ থাকে, এই সোনার খাঁচায়, ইটের জঙ্গলে,
বন্দিশালায়
হোটেলের বদ্ধ ঘরে, ফ্ল্যাট বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে
বৈদ্যুতিক আলোর এই অন্ধকারে,
এই স্নেহহীন, মায়াহীন, জলবায়ু শুন্য জতুগৃহে?
কতোদিন শুনি না ঘুঘুর ডাক, রাখালের বাঁশি,
টানা বাতাসের শব্দ
দেখিনা সবুজ মাঠ, উধাও দিগন্ত
ঘরের পিছনের ছোট্ট জংলায় দোয়েলের উড়াউড়ি,
কোথাও দেখিনা একটি ধানের শীষে গঙ্গাফড়িং,
লাউ জাংলার পাশে স্থলপদ্ম,
এখানে কী পেয়েছি প্রচুর সুখ, পেয়েছি প্রচুর শান্তি,

এবার অর্ধেক মানুষ আমি খুইয়ে এখানে
সব অনুভুতি, শুদ্ধতা, আনন্দ
সেই আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো।
সেই বন্ধুগাছ, বন্ধুপাখি, ডোবার কচুরি ফুল,
সেই কাদামাটি জলে ভেজা বাড়ি
কাজলাদিদির কথা লেখা সেই পাঠ্যবই, তোমাদের কারো
কিছুই জানি না;
পাখিরা যেমন আপন পাখিদের সাথে মিশে যায়
আমিও তেমনি আপন মানুষদের মাঝে মিশে যাবো
প্রিয় বৃক্ষ, প্রিয় নদী, আপন মানুষ।

ভালো লাগছে, রহস্যপ্রবণ লাগছে

আবুল হাসান

ভালো লাগছে। এতকাল পরে আজো মানুষকে ভালো লাগছে।
রহস্যপ্রবণ লাগছে।
বড় তরতাজা লাগছে। যেমন যুবতী, যেমন জরায়ু, যেমন শিশির

ভালো লাগছে। ফুল ও পূর্ণিমা, পুরাতন ভালোবাসা ভালো লাগছে।
মানুষ এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে ফিরছে। মানুষকে ভালো লাগছে।
মানুষকে মারা আজ কোনো কঠিন ব্যাপার নয়; সব সহজ।

জর্জর সঙ্গম, ফুল, জন্মে জেগে ওঠা মৃত্যু, অন্ধকার। সব সহজ।
কোনোকিছু, আজ আর কোনোকিছু কঠিন ব্যাপার নয়।
ভালো লাগছে। বেরিয়ে আসছে বিষ, ক্ষয়, মৃত্যু ও জরা।
ফুলের মালায় বেরিয়ে আসছে অবেলায় অজগর, ভালো লাগছে।
রহস্যপ্রবণ লাগছে।

সুন্দর ব্যর্থতা ঝরছে দোরগোড়ায়। ভালো লাগছে। মানুষ লিখতে পারছে
কুকুর হইতে সাবধান, বাগানের ফুল ছিঁড়িও না আর নীরবতা আবশ্যক
ভালো লাগছে। এতকাল পরে আজো মানুষকে ভালো লাগছে।
রহস্যপ্রবণ লাগছে।

ফুল ছিঁড়ে ফেলতে ফেলতে ফের বলছে ফুল ছিঁড়িও না।
কুকুরের মধ্যে ফের কুকুর বসিয়ে ফের বলে উঠছে কুকুর হইতে সাবধান!

ভালো লাগছে। মানুষকে ভালো লাগছে। ভালো লাগছে। সারাদিন
ভালো লাগছে। সারাদিন রহস্যপ্রবণ লাগছে, ভালো লাগছে,
ভালো লাগছে না।

অদ্ভুত আঁধার এক

জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নাই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহত্** সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

অমলকান্তি

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারতো না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণে কাক ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামফলের পাতায়
যা নাকি অল্প একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে,
চা খায়, এটা ওটা গল্প করে, তারপর বলে, `উঠি তাহলে'।
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ সকলেরি ইচ্ছাপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি, রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।।

সূর্যতামসী

জীবনানন্দ দাশ

কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র'য়ে গেছে - তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন সিন্ধুর সুর:
মরণের - জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।
একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে -
সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে
আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক'রে জেগে ওঠে?
কোথাও ডানার শব্দ শুনি;
কোন দিকে সমুদ্রের সুর -
দক্ষিণের দিকে,
উত্তরের দিকে,
পশ্চিমের পানে?

সৃজনের ভয়াবহ মানে;
তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে
সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;
ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল
ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ - তুমি?
সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল
সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!
বিলীন হয় না মায়ামৃগ - নিত্য দিকদর্শিন;
যা জেনেছে - যা শেখেনি -
সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত জ্ব'লে
জাগে না কি হে জীবন - হে সাগর -
শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।

শীতরাত

জীবনানন্দ দাশ

এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।

শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে -
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।

এদিকে কোকিল ডাকছে - পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব'লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ'য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ'য়ে গেছে।

সিংহ হুঙ্কার ক'রে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক - আফিমের সিংহ - অন্ধ - অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।

সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ'শে খ'শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ, - তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।

সপ্তক

জীবনানন্দ দাশ

এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে; - জানি না সে এইখানে
শুয়ে আছে কিনা।
অনেক হয়েছে শোয়া; - তারপর একদিন চ'লে গেছে
কোন দূর মেঘে।
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে :
সরোজিনী চলে গেলো অতদূর? সিঁড়ি ছাড়া - পাখিদের
মত পাখা বিনা?
হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির
ভূত বলে: আমি তো জানি না।
জাফরান - আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগে:
লুপ্ত বেড়ালের মত; শূণ্য চাতুরির মূঢ় হাসি নিয়ে জেগে।

বনলতা সেন

জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে আরো দূর অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি। বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি। আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য। অতিদূর সমুদ্রের 'পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা,
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে। বলেছে সে, "এতোদিন কোথায় ছিলেন?"
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন।


সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে। ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।
পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী। ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন।
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

হায় চিল

জীবনানন্দ দাশ

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!

সে

জীবনানন্দ দাশ

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলো: 'এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল:
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।'

'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?'
মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।

সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসে
মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।

বাংলার মুখ

জীবনানন্দ দাশ

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর: অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতো বড় পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েল পাখি - চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম - বট - কাঁঠালের - হিজলের - অশথের করে আছে চুপ ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে ;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল - বট - তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ

দেখেছিল ; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে -
কৃষ্ণা - দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায় -
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিল - একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদ - নদী - ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায় ।

Wednesday, April 29, 2009

সুদর্শনা

জীবনানন্দ দাশ

একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যের লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাড়িয়ে
শুনেছি কিন্নর কন্ঠ দেবদারু গাছ,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে।

সবচেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রা‍‍‍‌‌‌‌‌ত্রি ভালো;
তবুও সময়ে স্থির নয়;
আরেক গভীরতর তোমার বলয়।

এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন
তোমার শরীর; তুমি দান করনি তো;
সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে
সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত ।

আকাশলীনা

জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা এই যুবকের সাথে কথা;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর ।

কী কথা তাহার সাথে ? তার সাথে!
আকাশ আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে ।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস
আকাশের ওপারে আকাশ ।

ঘোড়া

জীবনানন্দ দাশ

আমরা যাইনি মরে আজও - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন - এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে ।

আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে;
চায়ের পেয়ালা ক'টা বেড়ালছানার মতো - ঘুমে - ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে

হিম হয়ে নড়ে গেল ও - পাশের পাইস্ - রেস্তরাঁতে,
প্যারাফিন - লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে ।
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব নিওলিথ - স্তব্ধ তার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।

যাতায়াত

হেলাল হাফিজ

কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।

কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।

নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেউ বলেনি ভাল থেকো সুখেই থেকো
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো।

জন্মাবধি ভেতর থেকে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্স্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।

ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই
দুঃসময়ে এতটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।

কেউ বলেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালবাসি।

ডাকাত

হেলাল হাফিজ

তুমি কে হে?
সোনালী ছনের বাড়ি তছনছ করে রাতে
নির্বিচারে ঢুকে গেলে অন্দর-মহলে
বেগানা পুরুষ, লাজ শরমের মাথা খেয়ে
তুমি কে হে?

তোমাকে তো কখনো দেখিনি আগে এ তল্লাটে
মারী ও মড়কে, ঝড়ে, কাঙ্খিত বিদ্রোহে।
আমাদের যুদ্ধের বছরে
ভিন গেরামের খতো মানুষের পদচারণায়
এ বাড়ি মুখর ছিলো, তোমাকে দেখিনি ত্রি-সীমায়।

চতুর বণিক তুমি আঁধারে নেমেছো এই বানিজ্য ভ্রমণে,
কে জানে কি আছে পাড়া-পড়শীর মনে!
লোভে আর লালসায় অবশেষে আগন্তুক সর্বস্ব হারাবে,
কেন না প্রভাত হলে চারিদিকে মানুষের ঢল নামে যাবে।

সম্প্রদান

হেলাল হাফিজ

ভাদ্রের বর্ধিত আষাঢ়ে সখ্য হয়েছিলো।
সে প্রথম, সে আমার শেষ।

পথে ও প্রান্তরে, ঘরে,
দিনে রাতে, মাসে ও বছরে
সমস্ত সাম্রাজ্য জুড়ে
সে আষাঢ় অতটা ভেজাবে আমি ভাবিনি কসম।

আমার সকল শ্রমে, মেধা ও মননে
নিদারুন নম্র খননে
কি নিপুন ক্ষত দেখো বানিয়েছে চতুর আষাঢ়।

একদিন
সব কিছু
ছিলো তোর
ডাক নামে,
পোড়ামুখী
তবু তোর
ভরলো না মন,-
এই নে হারামজাদী একটা জীবন।

অশ্লীল সভ্যতা

হেলাল হাফিজ

নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না!

হিরনবালা

হেলাল হাফিজ

হিরনবালা তোমার কাছে দারুন ঋণী সারা জীবন
যেমন ঋণী আব্বা এবং মায়ের কাছে।

ফুলের কাছে মৌমাছিরা
বায়ুর কাছে নদীর বুকে জলের খেলা যেমন ঋণী
খোদার কসম হিরনবালা
তোমার কাছে আমিও ঠিক তেমন ঋণী।

তোমার বুকে বুক রেখেছি বলেই আমি পবিত্র আজ
তোমার জলে স্নান করেছি বলেই আমি বিশুদ্ধ আজ
যৌবনে ঐ তৃষ্ণা কাতর লকলকে জিভ
এক নিশীথে কুসুম গরম তোমার মুখে
কিছু সময় ছিল বলেই সভ্য হলো
মোহান্ধ মন এবং জীবন মুক্তি পেলো।

আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর এসেছে,
নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?

আমাকে ভালবাসার পর

হুমায়ুন আজাদ

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক'রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক'রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ'য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ'য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগন।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ'লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।

আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প'ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।

Sunday, April 26, 2009

আমার আশ্চর্য ফুল

বিনয় মজুমদার

আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না ক'রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-

আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রানের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো , চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে।

কাগজ কলম নিয়ে

কাগজ কলম নিয়ে
বিনয় মজুমদার

কাগজ কলম নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা প্রয়োজন আজ;
প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কি অস্পষ্ট আত্নতৃপ্তি সঙ্গে নিয়ে আসে।
সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু
কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্কস্থাপন করা যায় না এখনো।
সকল ফুলের কাছে এত মহোময় মনে যাবার পরেও
মানুষের কিন্তু মাংসবন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।
বর্ণাবলেগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থূল ব'লে মনে হয়।
অথচ আলেখ্যশ্রেণী কিছুটা দূরত্বহেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।
হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;
এই যে অমেয় জল-মেঘে মেঘে তনুভূত জল-
এর কতোটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?
ফসলের ঋতুতে অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।
তবু কি আশ্চর্য, দ্যাখো উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়।

Wednesday, April 22, 2009

প্রশ্ন

পূর্ণেন্দু পত্রী

ছটাক খানেক বুকে,
একটা গোটা আকাশ এবং
জলের স্থলের গা ভর্তি রং
সব পড়েছে ঝুঁকে।
কাকে কোথায় রাখি?
বুকের মধ্যে হেসে উঠল
শেকল-পরা পাখি।

কেবল আমি হাত বাড়ালেই

পূর্ণেন্দু পত্রী

হাওয়া তোমার আঁচল নিয়ে ধিঙ্গীনাচন করলো খেলা
সকাল বিকেল সন্ধেবেলা
চোখের খিদের আশ মেটালো লম্পটে রোদ রাস্তা ঘাটে
যখন হাঁটো সঙ্গে হাঁটে
বনের পথে হাঁটলে যখন কাঁটাগাছে টানলে কাপড়
চ্যাংড়া ছেঁড়ার ফাজলামিকে ভেবেছিলাম মারবে থাপড়।
একটা নদীর লক্ষটা হাত, ভাসিয়ে দিলে সর্বশরীর
লুটপাটেতে ছিনিয়ে নিলে ওষ্ঠপুটের হাসির জরির
জেল্লাজলুস।
কেবল আমি হাত বাড়ালেই, মাত্র আমার পাঁচটা আঙুল
তোমার মহাভারত কলুষ।

রক্তে মাংসে মনুষ্যজীব, সেই দোষেতেই এমন কাঙাল।
কিন্তু তোমার খবর নিতে আমার কাছেই আসবে ছুটে
অনন্তকাল ।

সিঁড়ি

পূর্ণেন্দু পত্রী

কত রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
সরল সিঁড়ি শীতল সিঁড়ি
পদোন্নতির পিছল সিঁড়ি
অন্ধ এবং বন্ধ সিঁড়ি
কদম ফুলের গন্ধ-সিঁড়ি
ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
কত রকম সিঁড়ির ধাপে কত রকম জল
পা পিছলে অধঃপতন
ভাসতে পারো মাছের মতন
ডুব সাঁতারে মুঠোয় পেলে সঠিক ফলাফল।
কত রকম জলের ভিতর কত রকম মাছ
চুনো পুঁটি রাঘব বোয়াল যার যে রকম নাচ।
পেট চিরলে আংটি কারো
কারো শুধু আঁশ
দীর্ঘতর ফুসফুসে কার দীর্ঘশ্বাস।

সিঁড়ির নীচে জল এবং সিঁড়ির উপর ছাদ
মেঘও পাবে মানিক পাবে
বজ্রধ্বনির খানিক পাবে
পুড়তে চাইলে রোদ
জ্যোৎস্না থেকে চাইতে পার সার্থকতাবোধ।

অনেকরকম সিঁড়ি আছে ওঠা নামা হাঁটার
উর্ধ্বে অভিষেকের তোরণ
নিচের ঝোপটি কাঁটার।

অনেককেই তো অনেক দিলে

পূর্ণেন্দু পত্রী

আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
এর আকাশে ওর আকাশে
ওষ্ঠপুটের অনেক পাখি উড়িয়ে দিলে
পায়রাকে ধান খুঁটতে দিলে খোয়াই জুড়ে
বুকের দুটো পর্দাঢাকা জানলা খুলে
কতজনকে হাত-ডোবানো বৃষ্টি দিলে।
কত মুখের রোদের রেখা মুছিয়ে দিলে নীল কমলে।


আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
চায়ের কাপে মিষ্টি দিলে হাসির থেকে
নকশাকাটা কাঁচের গ্লাসে সরবতে সুখ মিশিয়ে দিলে।
নখের আঁচড় কাটতে দিলে ডালিমবনে
দাঁতের ফাঁকে লাল সুপুরি ভাঙতে দিলে।

আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
একটা জিনিস দাওনি কেবল কাউকে তুমি
আলমারিটার ঝুলন-চাবি।

শূন্যতাকে রঙীন করার সাম্পু সাবান
সায়া শাড়ীর ভাঁজের নিচে
একটা ছোটো কৌটো আছে।
তার ভিতের ভোমরা থাকে।

সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন হাসিতে রক্ত ঝরে ঠিক অবিকল হাসির মতো
সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন রুমালে কান্না এবং কোন আঁচলে বুকের ক্ষত
দেয়ালজুড়ে বিকট ছাড়া ভাবছো বুঝি অন্য কারো?
কার ছায়াটি কিরূপ গাঢ় সে ভোমরাটি সকল জানে।

আমার কিছু লিখতে হবে
লিখতে গেলে ভোমরাটি চাই।
তোমার ঘরের আলমারিটার ঝুলন-চাবি
আমায় দেবে?

বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি

পূর্ণেন্দু পত্রী

বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি।
নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুষ্পদল।
নিজের কস্তুরী গন্ধে নিজেই বিহবল।
বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশী বারংবার
আত্নজ কুসুমগুলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলঙ্কৃত করে ওষ্ঠতল।
আমি একা ফুটিতে পারি না
আমি একা ফোটাতে পারি না
রক্তের বিষাদ থেকে আরক্তিম একটি কুসুমও।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো ।

বহু জন্ম বসন্তের অম্লান মন্জরী ফুটে আছো
নয়নের পথে দীর্ঘ ছায়াময় বনবিথীতল
ওষ্ঠের পল্লব জুড়ে পুষ্প বিচ্ছুরণ।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।

তুমি পারো করতলে তুলে নিতে আমার বিষাদ
ভিক্ষাপাত্র ভরে দিতে পারো তুমি অমর-সম্ভারে।
সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আছো চন্দ্রালোকে, চন্দনের ক্ষেত।
আমার উদগত অশ্রু অভ্যর্থনা করে নিতে
পারো না কি তোমার উদ্যানে ?

মোহিনীরা স্বভাবে নির্মম।
আর যারা ভালবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্নার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়।

আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধ

সমুদ্র গুপ্ত

আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধকে আমি
অভিবাদন জানাবো
যিনি আমাকে তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে
দিন দিন শিক্ষিত করে তোলেন, যিনি
তাঁর কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজ
একটি একটি করে খোলেন, আর
আমাকে দেখান
মানুষের কব্জীর যাবতীয় কাজ ও কারুকাজ
তিনি দেখান আর বলেন কোমল স্বরে
শ্রেনীযুদ্ধের ইতিহাসই মানুষের ইতিহাস
আমার চোখের সামনে একেকটি প্রাচীন গুহামুখ
খুলে যায় নিঃশব্দে

বৃদ্ধের দুই চোখ জ্বলে ওঠে
মোমবাতির শিখার মত সাবলীল নরোম আলোয়
আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
লক্ষ বছর ধরে হেঁটে যাই পা গুণে গুণে
চোখে খোলা তলোয়ারের ঝিলিক
আঙুল জ্যামিতিক কাঁটার মত নির্ভুল, আর
নিঃশ্বাস পিঁপড়ের চেয়েও বে স্পর্শপ্রবণ

প্রত্যেক যাত্রার শেষে সেই সৈম্যবৃদ্ধ বলেন
মানুষের ইতিহাস ক্রমশ এগোয় সম্মুখে
সমৃদ্ধতর এবং বেঁচে থাকার দিকে
আমি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি, মুহূর্তেই শিখে ফেলি
মানুষের চেতনা যতোই স্বপ্নাবৃত থাক
একদিন এই স্বপ্ন ভাঙবেই
স্বদেশের মানুষেরা ফিরে আসবে মাতৃভূমির স্বাধীনতার দিকে
এবং
রৌদ্রের বিপরীত ঝিলিকে ঝিলিকে উঠবে জীবনের চোখ

আমি
স্বাধীনতার তুমুল লড়াই শেষে
করমর্দন করবো আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধকে
আমি তাঁকে জানাবো অভিবাদন
যাঁর নির্দেশে
রাত্রি শেষের মোরগের মতো ডেকে ওঠে আমার জীবন

প্রতিহিংসা

সমুদ্র গুপ্ত

তোমার দুধের বাটিতে আমি
বেড়ালের সাদা লোম মিশিয়ে দেবো
চোখে ফুঁক দেবো ঢুকিয়ে দেবো ভুরু

পায়ের তালুতে গুল লাগিয়ে
পিঁপড়া লেলিয়ে দেবো
শুকনো চুলের মধ্যে
পাকা খাগড়ার গোটা ছড়িয়ে
ডলে দেবো আচ্ছা মতোন

পাঁজরের একটু উপরে , পিঠের বেকায়দা স্থানে
বিছুটির পাতা ঘষে দেবো
কানের লতির মধ্যে কাঁচা লংকা ভেঙে দেবো

নাভির ওপর শুকনো ধান রেখে
পা দিয়ে ডলে ডলে চাল করবো
তোমার দাম্পত্য ঝগড়ার সময়
হেঁসেলে লবণ ছিটাবো
পাকা ধানে মই দেবো, তোমার
বাড়া ভাতে ছিটিয়ে দেবো ছাই
মনে নেই
তুমি আমার স্বপ্নের বাড়ির উঠানে
দুঃস্বপ্নের কুকুর ছেড়েছ !

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মা'য়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।

যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।

আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।

আমরা কি তা'র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা'র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
তিনি মৃত্তিকার গভীরে
কর্ষণের কথা বলতেন
অবগাহিত ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
সবত্সা গাভীর মত
দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।

যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না
শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।

যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
যূথবদ্ধ হলাম।
বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপে
মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
বারিসিক্ত ভূমিতে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
আনিঃশ্বাস গ্রহণ করলাম।
তখন বিষসর্প প্রভুগণ
অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।

যখন কবিকে হত্যা করা হল
তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।

তখন আমরা দুঃখকে ক্রোধ
এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।

নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্সারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।

আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
অভ্যূত্থানের কথা বলছি
উত্‌ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত
কমলের চোখের কথা বলছি
প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
আমি বহ্নমান মৃত্যু
এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।

যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের মত
ঋজু এবং সংহত হলাম।
পর্বত শৃংগের মত
মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
দিকচক্রবালের মত
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উত্পাটিত করলাম।

তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।

উত্‌ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।

আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের
উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের
অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃংখলিত বৃক্ষের
উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না
যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।

যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
নিঃসঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।

যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
স্মরণ করলাম।
প্রপিতামহের বীর গাঁথা
স্মরণ করলাম।
আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
স্মরণ করলাম।

তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।

আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।

স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।

যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
সে কবি
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
সে কবি
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।

খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
শস্যের পরিচর্যা করছি।

আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমার সন্তানেরা
আমি তোমাদের বলছি।
যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
সূর্যের মত সত্য হবে
সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।

আমি বিষসর্প প্রভুদের
চির প্রয়াণের কথা বলছি
দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
পরিসমাপ্তির কথা বলছি
সুতীব্র ঘৃণার
চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।

আমি সুপুরুষ ভালবাসার
সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।

যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মত্স্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ


আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।

তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।

জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।

আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মা'য়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।

যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা'য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।

সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।

আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।

সত্যবদ্ধ অভিমান

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়--
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো--
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে....
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান--চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোন মিথ্যে কি মানায় ?

মানুষ

নির্মলেন্দু গুণ

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।


আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তfও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।


আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।


আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।


মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।


আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।

আমার হবেনা, আমি বুঝে গেছি

আবুল হাসান

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
ক্ষমা করবেন বৃক্ষ, আপনার শাখায় আমি সত্য পাখি বসাতে পারবো না !
বানান ভীষণ ভুল হবে আর প্রুফ সংশোধন করা যেহেতু শিখিনি
ভাষায় গলদঃ আমি কি সাহসে লিখবো তবে সত্য পাখি, সচ্চরিত্র ফুল ?

আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই, দেখি
আমার কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল !

উচ্চারণগুলি শোকের

আবুল হাসান

লক্ষি বউটিকে
আমি আজ আর কোথাও দেখিনা,
হাটি হাটি শিশুটিকে
কোথাও দেখিনা,
কতগুলি রাজহাঁস দেখি
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি,
কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখিনা
শিশুটিকে কোথাও দেখিনা !


তবে কি বউটি রাজহাঁস ?
তবে কি শিশুটি আজ
সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ ?


অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো,
শিমুল তুলোর মতো
সোনারূপো ছড়ালো বাতাস ।


ছোটো ভাইটিকে আমি
কোথাও দেখিনা,
নরোম নোলক পরা বোনটিকে
আজ আর কোথাও দেখিনা !


কেবল পতাকা দেখি,
কেল উৎসব দেখি ,
স্বাধীনতা দেখি,

তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পাতাকা ?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব ?