Monday, July 4, 2011

মানুষ

নির্মলেন্দু গুণ

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।

আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তfও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।

মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।

তোমার চোখ এতো লাল কেন?

নির্মলেন্দু গুণ

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরজা খুলে দেবার জন্য।
বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক। আমি হাত পাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না।
আমি জানি এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুকঃ
আমার জল লাগবে কিনা, আমার নুন লাগবে কিনা,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরোও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কিনা।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভেতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুকঃ “তোমার চোখ এতো লাল কেন?”

অনন্ত বরফবীথি

নির্মলেন্দু গুণ

মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যদি শিমুলের তুলা হতাম, বাতাসে উড়িয়ে দিতে বলতাম,
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি বাতাসের চেয়ে হালকা নই।
আমাকে তোমরা কাঠের আগুনে পুড়িয়ে ফেলো না,
কিংবা মাটি খুঁড়ে কবর দিও না আজিমপুর বা বনানীতে।
বর্জ্যপদার্থের মতো আমি চাই না মাটিতে মিশে যেতে।
মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যাতে জলপথে ভাসতে-ভাসতে, ভাসতে-ভাসতে
আমি পৌঁছুতে পারি পৃথিবীর নব-নব দেশে।

জাপান-সাগরের মালবাহী জাহাজের সাথে পাল্লা দিয়ে
আমি ঢেউয়ের চূড়ায় ভেসে বেড়াবো, প্রাণহীন রাজর্হাস।
তার আগে ডান দিকে ঘুরে, আমি একটু বিশ্রাম নেবো
সিডনি বন্দরে, যদি সেখানে হঠাৎ মৈত্রেয়ীর দেখা পাই।
ভারত বনাম নিউজীল্যাণ্ডের একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ
দেখতে আমি দু’দিনের জন্য থামবো ডুনেডিনে।
একরাত্রির জন্য ইচ্ছে আছে সায়গন নদীতে যাবার।
রেড রিভারে রঙিন মাছের সঙ্গে খেলা করবো এক দিন।
একদিন লস এঞ্জেলেসে হঠাৎ চুম্বন হয়ে ভেসে উঠবো
এক প্রিয়দর্শিনী নাসিমার হাসিমাখা মুখের লজ্জায়।
তারপর কোনো এক গভীর নিশিথে আমি ধরা পড়বো
ক্যালিফোর্নিয়ায়, সান ডি আগোর বৃদ্ধ জেলের জালে।

বলিভিয়ার জঙ্গলে ক্ষিপ্র-চিতার হরিণ শিকার দেখবো
একদিন, একদিন পেরুর অরণ্যঘেরা নির্জন দ্বীপে যাবো,
একদিন অলিভিয়ার সোনালি দাঁতের হাসি দেখার জন্য
ভাসতে-ভাসতে চলে যাবো এন সালভাদর।

আমার আফ্রিকান বন্ধুদের দেখতে দক্ষিণ আটলান্টিকের
জলে ভেসে ভেসে আমি কেপটাউন আর এডেন বন্দর ছুঁয়ে
কয়েকদিনের জন্য যাবো ঘানা, জিম্বাবুই আর জাম্বিয়ায়।
তারপর নিউ ইয়র্ক বন্দরের পথে আমি একটু জিরিয়ে নেবো
নিউ ফাইণ্ডল্যাণ্ডের তুষার-শীতল সবুজ শ্যাওলার নিচে।
বাল্টিমোর, মেরীল্যাণ্ড হয়ে পূরবীর হারানো স্মৃতির টানে
শুধু একরাত্রির জন্য আমি যাবো ফিলাডেলফিয়ায়।

এন্টার্কটিকায় যখন পেঙ্গুইন পাখিদের সঙ্গে দেখা হবে,
আমি তাদের কাছে বলবো আমার যাত্রাপথের গল্প।
তাদের আমি আবৃত্তি করে শোনাবো আমার কবিতাগুলো
তাদের আতিথ্যে মহানন্দে কাটিয়ে দেবো কয়েক বছর।

হ্যাঁ, আমি ইউরোপেও যাবো, যাবো ভার্সেই, বুদাপেষ্ট।
রাইন-দানিয়ুব-ভলগা-লেনার জলে ভাসতে-ভাসতে
আমি পৌঁছাবো দূর-প্রাচ্যে, খাবারভক্সে, সাইবেরিয়ায়।
ভেঙে-যাওয়া সোভিয়েট ইউনিয়ন আর আমার দোভাষিকা
সুন্দরী লেনা দোব্‌রাভ্‌স্কায়ার কথা ভাবতে-ভাবতে,
মেঘের মশারি টানিয়ে বৈকাল হ্রদের জলে দেবো দীর্ঘ ঘুম।
জাগবো না, যতক্ষণ না ইস্রাফিলের শিঙার ধ্বনিতে
গলতে শুরু করে অনন্ত বরফবীথি; যতক্ষণ না
পদার্থের বিক্রিয়ায় স্থলভাগ স্থান বদল করে
জল-ভাগের সঙ্গে।

স্ববিরোধী

নির্মলেন্দু গুণ

আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ন বর্ষায়,
কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত ।

আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে,
কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল ।

আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে,
কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি ।

আমি জন্মেছিলাম ছায়াসুনিবিড় গ্রামে,
ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা ।

জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম,
এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায় ।

আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম,
এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি ।

এক ধরনের এপিটাফ

নির্মলেন্দু গুণ

বায়ুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু;
জানি, একদিন বায়ুতেই যাবো মিশে ।
আমাকে তখন যদি দরকার হয় কারও,
আজকের মতো সহজে পাবে না খুঁজে ।
চৈত্রের ঝড় হয়ে লুটিয়ে পড়বো আমি
বৃক্ষপত্রে, ধু-ধু মাঠে, –মঠের গম্বুজে ।

বায়ুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু;
জানি, একদিন বায়ুতেই যাবো মিশে ।
তখন আমাকে যদি খোঁজ, যদি খোঁজ,
শুভ্র অভ্রবিন্দুবৎ তখন আমাকে পাবে
কম্পমান পদ্মের পাতায়, ঘাস-শীষে ।
মধুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু;
মৃত্যু হয়ে একদিন মিশে যাবো বিষে ।

মেঘ বলতে আপত্তি কি ?

জয় গোস্বামী

মেঘ বলতে আপত্তি কি ?
বেশ, বলতে পরি
ছাদের ওপোর মেঘ দাঁড়াতো
ফুলপিসিমার বাড়ি
গ্রীষ্ম ছুটি চলছে তখন
তখন মানে ? কবে ?
আমার যদি চোদ্দো, মেঘের ষোলো-সতেরো হবে
ছাদের থেকে হাতছানি দিতো
ক্যারাম খেলবি ? … আয় …
সারা দুপুর কাহাঁতক আর ক্যারম খেলা যায়
সেই জন্যেই জোচ্চুরি হয়
হ্যা,ঁ জোচ্চুরি হতো
আমার যদি চোদ্দো, মেঘের পনেরো-ষোলো মত

ঘুরিয়ে দিতে জানতো খেলা শক্ত ঘুঁটি পেলে
জায়গা মত সরিয়ে নিতো আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে
শুধু আঙ্গুল ? … বোর্ডের উপর লম্বা ফ্রকের ঝুল
ঝপাং ফেলে ঘটিয়ে দিতো ঘুঁটির দিক ভুল
এই এখানে … না ওখানে ..
এই এইটা না ঐটা
ঝাঁপিয়ে পরে ছিনিয়ে নিলো ঘুঁটির বাক্সটা
ঘুঁটির ও সেই প্রথম মরন
প্রথম মরা মানে ?
বুঝবে শুধু তারাই … যারা ক্যারাম খেলা জানে

চলেও গেলো কদিন পরে .. মেঘ যেমন যায়
কাঠফাটা রোদ দাঁড়িয়ে পড়ল মেঘের জায়গায়
খেলা শেখাও, খেলা শেখাও, হাপিত্যেস কাক
কলসিতে ঠোঁট ডুবিয়ে ছিলো, জল তো পুরে খাক
খাক হোয়া সেই কলশি আবার পরের বছর জলে …
ভরল কেমন তোমায় ? …
ধ্যাত্, সেসব কি কেউ বলে ? …

আত্মীয় হয় .. আত্মীয় হয় ? আত্মীয় না ছাই
সত্যি করে বল এবার, সব জানতে চাই
দু এক ক্লাস এর বয়স বেশি, গ্রীষ্ম ছুটি হলে
ঘুরেও গেছে কয়েক বছর, এই জানে সক্কলে
আজকে দগ্ধ গ্রীষ্ম আমার তোমায় বলতে পারি
মেঘ দেখতাম, ছাদের ঘরে, ফুলপিসিমার বাড়ি

বিবাহিতাকে

জয় গোস্বামী

কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, তুমি আমার সামনে দাড়ালেই আমি
তোমার ভিতরে একটা বুনো ঝোপ দেখতে পাই।
ওই ঝোপে একটা মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া আছে।
অনেকদিন ধ’রে আছে। কিন্তু আশ্চর্য যে
এই মৃতদেহ জল, বাতাস, রৌদ্র ও সকলপ্রকার
কীট-বীজাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে। এর পচন নেই।
বন্য প্রাণীরাও এর কাছে ঘেঁষে না।
রাতে আলো বেরোয় এর গা থেকে।
আমি জানি, মৃতদেহটা আমার।
কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, এই জারিজুরি এবার ফাঁস হওয়া প্রয়োজন।
আর তা হবেও, যেদিন চার পায়ে গুঁড়ি মেরে গিয়ে
পা কামড়ে ধ’রে, ওটাকে, ঝোপ থেকে
টেনে বার করব আমি।

হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে

অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে

করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো

করেছো, অতল; করেছিলে; পড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল–ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;
–’পড়ে রইল যে!’ পড়েই থাকত–সে-লেখা তুলবে বলে

কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।

তখন সত্যি মানুষ ছিলাম

আসাদ চৌধুরী

নদীর জলে আগুন ছিল
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার
উদাস করা দৃষ্টিতে।
আগুন ছিল গানের সুরে
আগুন ছিল কাব্যে,
মরার চোখে আগুন ছিল
এ কথা কে ভাববে ?
কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়
ফোঁসে সাপের ফণা
শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা।
আগুন ছিল মুক্তিসেনার
স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে
কাঁপছিল সব অন্যায়।
এখন এসব স্বপ্নকথা
দূরের শোনা গল্প,
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।

প্রতিক্ষার শোকগাথা

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আর আমার হাত ঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে !

টুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী

এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো এ্যাসট্রেতে !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আজ স্বাতী ?

তোমার কথার মতো নরম সবুজ
কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে

তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ !

তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়

আর একটি অস্থির নীল প্রজাপতি পর্দার বুনট থেকে উড়ে এসে
ঢুকে গেছে আমার মাথায় !

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসছোনা আজ স্বাতী ?

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আর স্বাতী ?

অপরূপ বাগান

চলে গেলে- তবু কিছু থাকবে আমার : আমি রেখে যাবো
আমার একলা ছায়া, হারানো চিবুক, চোখ, আমার নিয়তি।
জল নেমে গেলে ডাঙ্গা ধরে রাখে খড়কুটো, শালুকের ফুল :
নদীর প্রবাহপলি, হয়তো জন্মের বীজ, অলঙ্কার- অনড় শামুক !

তুমি নেমে গেলে এই বক্ষতলে সমস্ত কি সত্যিই ফুরোবে ?
মুখের ভিতরে এই মলিন দাঁতের পংক্তি- তা হলে এ চোখ
মাথার খুলির নীচে নরোম নির্জন এক অবিনাশী ফুল :
আমার আঙ্গুলগুলি, আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি, অভিলাষগুলি ?

জানি কিছু চিরকাল ভাস্বর উজ্জ্বল থাকে, চির অমলিন !
তুমি চলে গেলে তবু থাকবে আমার তুমি, চিরায়ত তুমি !

অনুপস্থিতি হবে আমার একলা ঘর, আমার বসতি !

ফিরে যাবো সংগোপনে, জানবে না, চিনবে না কেউ;
উঠানে জন্মাবো কিছু হাহাকার, অনিদ্রার গান-

আর লোকে দেখে ভাববে- বিরহবাগান ঐ উঠানে তো বেশ মানিয়েছে !

যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না

আবিদ আজাদ

যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে যুদ্ধ শেষের
ভাঙা-পোড়ো একটা এয়ারপোর্টের মতো বেঁচে থাকবে তুমি
তোমাকে ঘিরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে স্কার্ট পরা বুড়ি-
বার্মিজ মহিলার মতো ভৌতিক নির্জনতা;
তোমাকে ঘিরে সারাক্ষণ ঝুলে থাকবে তছনছ তারের জটিলতা
লতাগুল্মময় ক্রেনের কংকাল, জং পড়া লোহালক্কর আর হিংস্র
ঘাসের মধ্যে ধু-ধু করবে তোমার জীবন
ভয়ার্ত সব মিলিটারী ভ্যান আর উল্টে থাকা ট্রলির পাশে ক্ষত-বিক্ষত
একটা চাঁদ ওঠা রানওয়ের মতো
তুমি মুখ লুকিয়ে রাখবে গা ছম-ছম করা জ্যোৎস্নায় ।

যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে জনহীন কোন
পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে
একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি
তোমাকে ঘিরে হা- হা করবে নিদাঘ রাত
দেখবে পর্যুদস্ত একটা হেলমেটের ফাটল দিয়ে দিয়ে মাথা
তুলছে একগুচ্ছ সবুজ তৃণ
শুনবে ধ্বংস্তুপের মধ্যে অর্ধডোবা সূর্যাস্তের মতো
আগুনলাগা বিলুপ্তপ্রায় লাউঞ্জ থেকে ভেসে আসছে
প্রেত হাসির শব্দ
তোমাকে ঘিরে নামবে এক জোড়া জনশূন্য বুটের স্তব্ধতা ।
যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে প্রতিদিন
দুর্ঘটনা দিয়ে শুরু হবে তোমার ভোর
সকাল সাতটা থেকে অনবরত টেলিফোন আসতে থাকবে
‘সান স্ট্রোকে’র সংবাদ
তোমার পাশের সাততলা জানলা থেকে লাফিয়ে পড়বে
কোঁকড়া চুলের যুবক
একদিন গলায় খুর চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়বেন সেই বুড়ো
সবুজ রঙ্গের গলাবন্ধ পরে স্টিক হাতে যিনি মর্নিংওয়াকে
বেরুতেন রোজ
একটি কিশোরী তার আব্বার রেজর থেকে লুকিয়ে নেবে ব্লেড
গভীর জ্যোৎস্নাঙ্কিত স্ট্রীটের মাথায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়বে
কালো রঙ্গের একটি গাড়ি
একজন মানুষ শিরিষ গাছের ভিতরে টিপে ধরবে আরেকজন মানুষের গলা
পার্কের ঝরাপাতার উপর সারারাত ধরে শিশিরে ভিজে যাবে
মৃত তরুণীর হাঁটুর ভাঁজ ।
যে শহরে আমি নাই আমি থাকবো না সে শহরে চরম
দুর্বোধ্যতম হয়ে বেড়ে ওঠবে তোমার বিষন্ন সন্তান
বার বার ক’রে বদলাতে হবে তার ঝাপসা চোখের চশমার গ্লাস
তুমি তাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে ভোরের ইস্কুলে

কিন্তু কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আর কোনদিন ফিরে আসবে না
নীল হাফ প‌্যান্ট পরা তোমার ছেলে, আসবে না , আসবে না
তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে ইস্কুল বাড়ির সামনে, রাস্তার ওপারে ।

যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে নিয়মিত
দুধের বোতল দিয়ে যাবে গাড়ি
কিন্তু সে দুধে মেশানো থাকবে গুঁড়ো বিষ
তোমার ফ্রিজের ভিতরে মরে পরে থাকবে শাদা ইঁদুর
তোমার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় বসে থাকবে একটা তেলাপোকা
তার রঙ হবে মারাত্মক রকম লাল
তোমার ওয়ারড্রোবের ভিতর থেকে হ্যাঙ্গার শুদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়বে মধ্য রাতে কাপড়-চোপড় ।
তুমি পালাতে চাইবে পালাতে চাইবে পালাতে চাইবে
ছুটে পালাবে
ছুটবে
ছুটতে ছুটতে ছুটতে তুমি নিচতলার জানালার একখন্ড পর্দার
মতো আটকে যাবে বারবার
তুমি উদ্র্ধশ্বাসে ছুটে পালাবে ঘুমের ভিতর
কিন্তু মৃতশহর শাণিত করে রাখবে তার সমস্ত রাস্তার বালি
তারার ভিতর থেকে সারারাত ধরে খ’সে পড়বে চূন
হঠাৎ লক্ষ লক্ষ হাতের করতালি বেজে উঠবে আতংকিত মোড়ে মোড়ে
দেখেব শাদা ট্রাফিক দাঁড়িয়ে আছে বাজপড়া তাল গাছের মতো
তার হাত দু’টো ঝুলছে চাঁদহীন মরা ডালের মতো
চোখে লোমহর্ষক দুটো গর্তের ভিতর দিয়ে চলেছে
বিষাক্ত পিঁপড়ের বাহিনী
তার মাথার ফাটলে গজিয়েচে একটা বটচারা
তোমার ভয়ার্ত চিৎকারে শুধু সেই মৃত ট্রাফিকের লাল
হা-এর ভিতর থেকে উড়ে যাবে একটা বনটিয়া ।
যে শহরে আমি থাকবো না সে শহরে
লিফট তোমাকে নিয়ে নেমে যাবে পাতালে
তোমাকে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো
পার্কের ধারের খাদে ছিটকে পড়বে বাস

লেকের হাঁসগুলি গুগলির মতো ঠুকরে খাবে মানুষের চোখ
আর খুব বিকাল বেলায় তুমি ক্লান্ত হ’য়ে
ক্লান্ত হ’য়ে
ক্লান্ত হ’য়ে
ফিরবে ঘরে
কিন্তু তোমার ঘরের নিঃসঙ্গ দরোজা
তোমাকে খুলে দিবে হু -হু শীতার্ত প্রান্তর
তোমার সোফা তোমাকে বসতে দিবে না
পাঠিয়ে দেবে বিছানায়
কিন্তু বিছানা তোমাকে শুতে দেবেনা
দাঁড় করিয়ে রাখবে হিমশীতল জানালায়
তুমি বাথরুমে যাবে, শাওয়ার খুলে দিলে ঝরবে রক্ত
তুমি বেসিনে নুয়ে পড়বে, পানির ঝাপ্টা দিতেই মনে হবে
কার গলা যেন পাটিয়ে দিচ্ছে যক্ষার ফুল
তুমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে,
দেখবে বিভৎস চিড় ধ’রে আছে আয়নায় ।
সেই চিড় ধরা আয়নার ভিতরে তারপর ক্রমশঃ
হারিয়ে যাবে তোমার আর্তনাদ
আর তোমার মনে হবে , আমি নেই ।

ভালোবাসার পাশেই

ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে
ওকে আমি কেমন করে যেতে বলি
ও কি কোনো ভদ্রতা মানবে না?
মাঝে মাঝেই চোখ কেড়ে নেয়,
শিউরে ওঠে গা
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

দু’হাত দিয়ে আড়াল করা আলোর শিখাটুকু
যখন তখন কাঁপার মতন তুমি আমার গোপন
তার ভেতরেও ঈর্ষা আছে, রেফের মতন
তীক্ষ্ম ফলা
ছেলেবেলার মতন জেদী
এদিক ওদিক তাকাই তবু মন তো মানে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

তোময় আমি আদর করি, পায়ের কাছে লুটোই
সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আগুন নিয়ে খেলি
তবু নিজের বুক পুড়ে যায়, বুক পুড়ে যায়
বুক পুড়ে যায়
কেউ তা বোঝে না

ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

হিমযুগ

শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে আসি শরীরের কাছে
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-
শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি
মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-

আমার নিশ্বাস পড়ে দ্রুত, বড়ো ঘাম হয়, মুখে আসে স’তি
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।
নয় ক্রুদ্ধ যুদ্ধ, ঠোঁটে রক্ত, জঙ্ঘার উত্থান, নয় ভালোবাসা
ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতোরো দিন পরে
অথবা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর
তুমি হও নদীর গর্ভের মতো, গভীরতা, ঠান্ডা, দেবদূতী
কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।

মৃত শহরের পাশে জেগে উঠে দেখি আমার প্লেগ, পরমাণু কিছু নয়,
স্বপ্ন অপছন্দ হলে পুনরায় দেখাবার নিয়ম হয়েছে
মানুষ গিয়েছে মরে, মানুষ রয়েছে আজও বেঁচে
ভুল স্বপ্নে, শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মতো যোনী
তুমি কথা দিয়েছিলে…..
এবার তোমার কাছে হয়েছি নিঃশেষে নতজানু
কথা রাখো! নয় রক্তে অশ্বখুর, স্তনে দাঁত, বাঘের আঁচড় কিংবা
ঊরুর শীৎকার
মোহমুগ্ধরের মতো পাছা আর দুলিও না, তুমি হৃদয় ও শরীরে ভাষ্য
নও, বেশ্যা নও, তুমি শেষবার
পৃথিবীর মুক্তি চেয়েছিলে, মুক্তি, হিমযুগ, কথা দিয়েছিলে তুমি
উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।।

দুটি অভিশাপ

সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম
কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি
প্রবল ঢেউ-এর মাথায় ফেনার মধ্যে
মিশে গিয়েছিল আমার থুতু
তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই
সমুদ্রের অভিশাপ।
মেল ট্রেনের গায়ে আমি খড়ি দিয়ে এঁকেছিলাম
নারীর মুখ
কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি
এমনকি, সেই নারীরও চোখের তারা আঁকা ছিল না
এক স্টেশন পার হবার আগেই বৃষ্টি, প্রবল বৃষ্টি
হয়তো বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়েছিল আমার খড়ির শিল্প
তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই
মেল ট্রেনের অভিশাপ।
প্রতিদিন পথ চলা কি পথের বুকে পদাঘাত?
নারীর বুকে দাঁত বসানো কি শারীরিক আক্রমণ?
শীতের সকালে খেঁজুর-রস খেতে ভালো-লাগা
কি শোষক সমাজের প্রতিনিধি হওয়া?
প্রথম শৈশবে সরস্বতী-মূর্তিকে আলিঙ্গন করা কি পাপ?
এ-সব বিষয়ে আমি মনসি’র করতে পারিনি
কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনতে পাই
সমুদ্র ও মেল ট্রেনের অভিশাপ।

ইচ্ছে

কাচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে
দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি
পায়ের তলায় আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট
যাদের পায়ের তলায় আছি, তাদের মাথায় চড়ে বসি
কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতই ইচ্ছে করে অবহেলায়
ধর্মতলায় দিন দুপুরে পথের মধ্যে হিসি করি।
ইচ্ছে করে দুপুর রোদে ব্লাক আউটের হুকুম দেবার
ইচ্ছে করে বিবৃতি দিই ভাঁওতা মেলে জনসেবার
ইচ্ছে করে ভাঁওতাবাজ নেতার মুখে চুনকালি দিই।
ইচ্ছে করে অফিস যাবার নাম করে যাই বেলুড় মঠে
ইচ্ছে করে ধর্মাধর্ম নিলাম করি মুর্গীহাটায়
বেলুন কিনি বেলুন ফাটাই, কাঁচের চুড়ি দেখলে ভাঙি
ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করি এবার পৃথিবীটাকে
মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি
আমরা কিছু ভাল্লাগে না।।

ভালোবাসা

ভালোবাসা নয় স্তনের ওপরে দাঁত?
ভালোবাসা শুধু শ্রাবণের হা-হুতাশ?
ভালোবাসা বুঝি হৃদয় সমীপে আঁচ?
ভালোবাসা মানে রক্ত চেটেছে বাঘ!

ভালোবাসা ছিল ঝর্ণার পাশে একা
সেতু নেই আকাশে পারাপার
ভালাবাসা ছিল সোনালি ফসলে হওয়া
ভালোবাসা ছিল ট্রেন লাইনের রোদ।

শরীর ফুরোয় ঘামে ভেসে যায় বুক
অপর বহুতে মাথা রেখে আসে ঘুম
ঘুমের ভিতরে বারবার বলি আমি
ভালোবাসাকেই ভালবাসা দিয়ে যাবো।

যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?

ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।

এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়

যেতে পারি
যে-কোনপ দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
একাকী যাবো না অসময়ে।।

কিছু মায়া রয়ে গেলো

সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত…
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই –
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই –
ঘৃনা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনজাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।

চাবি

আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো !

থুৎনি ‘পরে তিল তো তোমার আছে
এখন ? ও মন, নতুন দেশে যাবি ?
চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হলো ।

চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো–
লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা ?

অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু – ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা ?

দিন যায়

সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির |

ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদ্ লা হাওয়া নয়
ক্রন্দনরঙের মত নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার |

জয়দেবের মেলা থেকে গান ভেসে আসে
সঙ্গে ওড়ে ধুলোবালি, পায়ের নূপুর
সুখের চট্ কা ভাঙে গৈরিক আবাসে
দিন যায় রে বিষাদে, মিছে দিন যায় ।

মনে মনে বহুদূর চলে গেছি

মনে মনে বহুদূর চলে গেছি – যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু – প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে ।

কক্সবাজারে সন্ধ্যা

চাকমার পাহাড়ি বস্তি, বুদ্ধমন্দিরের চূড়া ছুঁয়ে
ডাকহরকরা চাঁদ মেঘের পল্লীর ঘরে ঘরে
শুভেচ্ছা জানাতে যায়, কেঁদে ফেরে ঘন্টার রোদন
চারদিকে। বাঁশের ঘরে ফালা ফালা দোচোয়ানি চাঁদ
পূর্ণিমার বৌদ্ধ চাঁদ, চাকমার মুখশ্রীমাখা চাঁদ!

নতুন নির্মিত বাড়ি সমুদ্রের জলে ঝুঁকে আছে।
প্রতিষ্ঠাবেষ্টিত ঝাউ, কাজুবাদামের গাছ, বালু
গোটাদিন তেতেপুড়ে, শ্রীতলে নিষ্ক্রান্ত হবে বলে
বাতাসের ভিক্ষাপ্রার্থী! জল সরে গেছে বহুদূর।
নীলাভ মসলিন নিয়ে বহুদূরে বঙ্গোপসাগর
আজ, এই সন্ধ্যাবেলা।

ব্ল্যাকডক মধ্যিখানে নিয়ে দুই কবির কৈশোর
দুটি রাঙা পদচ্ছাপ মেলানোর তদবিরে ব্যাকুল
ব্যর্থ আলোচনা করে, গানের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে,
বর্ণমালা নিয়ে লোফালুফি করে তীরে!
রুপচাঁদা জালে পড়ে, খোলামকুচির মতো খেদ
রীভীন কাঁকড়ার স্তুপ সংঘ ভেঙে ছড়ায় মাদুরে
একা একা। উপকূলে।

বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ কক্সবাজারের কনে-দেখা
আলোয় বিভ্রান্ত আজ। অধিকন্তু, ভরসন্ধেবেলা!

সরোজিনী বুঝেছিলো

দুপুরে আধার ঘর – মেঘে ঢাকা বিস্তৃত আকাশ
সরোজিনী চুরি করে নিয়ে যায় শাদা রাজহাঁস
হয়তো বা বৃষ্টি হবে, হয়তো বহিবে হাওয়া বেগে
মুখের অগ্নি কি তবে সরোজিনী ঢেকে ছিলো মেঘে?
মাঠের উপরে শাদা হাঁসগুলি চরেছিলো একা
সরোজ ঘরেই ছিলো – শুধু তার চোখমেলে দেখা
এইসব হাঁসেদের-বৃষ্টির সূচনা দেখে নেমে
জড়িয়ে গিয়েছে মেয়ে হাঁসে-ফাঁসে – কাপড়ের প্রেমে
শুধু চোখ মেলে দেখা, এই হাঁস স্পর্শ করা নয়
সরোজিনী বুঝেছিলো, শুধু তার বোঝেনি হদৃয়।

সব হবে

ভালোবাসা সবই খায় – এঁটো পাতা, হেমন্তের খড়
রুগ্ন বাগানের কোণে পড়ে থাকা লতার শেকড়
সবই খায়, খায় না আমাকে
এবং হাঁ করে রোজ আমারই সন্মুখে বসে থাকে।

আমি একটু একটু করে তাকে অবসন্ন হাওয়া দিতে পারি
একটু এনে দিতে পারি আমরুলের পাতার প্রকৃতি
স্মৃতির কাঁথায় তার স্পর্শ – যিনি উপস্থিত নেই
এইসব – দিতে পারি, এতে কি শ্রীমুখ ফেরাবে?

আমার ভিতরে কোনো গোলযোগ নেই, প্রেম নেই
অন্যমনস্কতা লেগে আমার ভিতরে হয়ে হয়ে নেই
কিছু বা পাথর, নেই ফুটোফাটা, ফেলে রাখা ধুলো
আমার ভিতরে আছে সর্বাঙ্গে রঙীন পথগুলো

এতে সবই হবে।

কবি ও কাঙাল

কিছুকাল সুখ ভোগ করে, হোলো মানুষের মত
মৃত্যু ওর, কবি ছিল, লোকটা কাঙাল ও ছিল খুব।
মারা গেলে মহোৎসব করেছিলো প্রকাশকগণ
কেন না, লোকটা গেছে, বাঁচা গেছে, বিরক্ত করবে না
সন্ধ্যেবেলা সেজে গুজে এসে বলবে না, টাকা দাও,
নতুবা ভাঙচুর হবে, ধ্বংস হবে মহাফেজখানা,
চটজলদি টাকা দাও-নয়তো আগুন দেবো ঘরে।

অথচ আগুনেই পুড়ে গেলো লোকটা, কবি ও কাঙাল!

এক অসুখে দুজন অন্ধ

আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |
হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?
সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক’রে
সঙ্গে আছে …
এক অসুখে দুজন অন্ধ !
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ ।

বদলে যাও, কিছুটা বদলাও

কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী
কিছুটা বদলাতে হবে সুর
সাতটি ছিদ্রের সূর্য; সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর
কিছুটা বদলাতে হবে

মাটির কনুই , ভাঁজ
রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে…

বদলে দাও, তুমি বদলাও
নইলে এক্ষুনি
ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী ,
যখোন যেখানে পাবে
মেরে রেখে যাবে,
তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও ।
বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও !

বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা

মনে আছে একবার বৃষ্টি নেমেছিল ?

একবার ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থেমেছিল
আমাদের ইস্টিশনে সারাদিন জল ডাকাতের মতো
উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল তারা;
ছোট-খাটো রাজনীতিকের মতো পাড়ায়-পাড়ায়
জুড়ে দিয়েছিল অথই শ্লোগান।

তবু কেউ আমাদের কাদা ভেঙে যাইনি মিটিং-এ
থিয়েটার পণ্ড হলো, এ বৃষ্টিতে সভা আর
তাসের আড্ডার লোক ফিরে এলো ঘরে;
ব্যবসার হলো ক্ষতি দারুণ দুর্দশা,

সারাদিন অমুক নিপাত যাক, অমুক জিন্দাবাদ
অমুকের ধ্বংস চাই বলে আর হাবিজাবি হলোনা পাড়াটা।

ভদ্রশান্ত কেবল কয়েকটি গাছ বেফাঁস নারীর মতো
চুল ঝাড়ানো আঙ্গিনায় হঠাৎ বাতাসে আর
পাশের বাড়ীতে কোনো হারমোনিয়ামে শুধু উঠতি এক আগ্রহী গায়িকা
স্বরচিত মেঘমালা গাইলো তিনবার !

আর ক’টি চা’খোর মানুষ এলো
রেনকোট গায়ে চেপে চায়ের দোকানে;
তাদের স্বভাবসিদ্ধ গলা থেকে শোনা গেল :
কী করি বলুন দেখি, দাঁত পড়ে যাচ্ছে তবু মাইনেটা বাড়ছেনা,
ডাক্তারের কাছে যাই তবু শুধু বাড়ছেই ক্রমাগত বাড়ছেই
হৃদরোগ, চোখের অসুখ !

একজন বেরসিক রোগী গলা কাশলো :
ওহে ছোকরা, নুন চায়ে এক টুকরো বেশী লেবু দিও।

তাদের বিভিন্ন সব জীবনের খুঁটিনাটি দুঃখবোধ সমস্যায় তবু
সেদিন বৃষ্টিতে কিছু আসে যায়নি আমাদের
কেননা সেদিন সারাদিন বৃষ্টি পড়েছিল,
সারাদিন আকাশের অন্ধকার বর্ষণের সানুনয় অনুরোধে
আমাদের পাশাপাশি শুয়ে থাকতে হয়েছিল সারাদিন

আমাদের হৃদয়ে অক্ষরভরা উপন্যাস পড়তে হয়েছিল !

আবুল হাসান

সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি ? এটা তাই ?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী ? উপগ্রহ ? কোনো রাজা ?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা ? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর ?

আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,
যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এঘরে ওঘরে যায়
সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী
তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে-
এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর,
একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,
তুই যার অনিচ্ছুক দাস !

হয়তো যুদ্ধের নাম, জ্যোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া,
নীল দীর্ঘশ্বাস কোনো মানুষের !
সত্যিই কি মানুষের ?

তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন
ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙ্গুল ?
ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল ?

একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই

একসময় ইচ্ছে জাগে, মেষপালকের বেশে ঘুরিফিরি;
অরণ্যের অন্ধকার আদিম সর্দার সেজে মহুয়ার মাটির বোতল
ভেঙ্গে উপজাতি রমণীর বল্কল বসন খুলে জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসি-

আর তারস্বরে বলে উঠি নারী, আমি মহুয়া বনের এই
সুন্দর সন্ধ্যায় পাপী, তোমার নিকটে নত, আজ কোথাও লুকানো কোনো
কোমলতা নেই, তাই তোমার চোখের নীচে তোমার ভ্রুর নীচে
তোমার তৃষ্ণার নীচে
এই ভাবে লুকিয়েছি পিপাসায় আকণ্ঠ উন্মাদ আমি
ক্ষোভে ও ঈর্ষায় সেই নগরীর গুপ্তঘাতক আজ পলাতক, খুনী
আমি প্রেমিককে পরাজিত করে হীন দস্যুর মতোন
খুনীকে খুনীর পাশে রেখে এখানে এসেছি, তুমি
আমাকে বলো না আর ফিরে যেতে, যেখানে কেবলি পাপ, পরাজয়
পণ্যের চাহিদা, লোভ, তিরীক্ষু-মানুষ- যারা কোজাগরী ছুরি
বৃষ্টির হল্লায় ধুয়ে প্রতি শনিবারে যায় মদ্যশালায়, যারা
তমসায় একফোঁটা আলোও এখন আর উত্তোলন করতে জানে না।
আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে কেবলি যাদের রক্ত, রাত্রিবেলা আমি আজ
তোমার তৃষ্ণার নীচে নিভৃতের জ্যোৎস্নায় হাঁটু গেড়ে বসেছি আদিম আজ
এখন আমার কোন পাপ নেই, পরাজয় নেই।
একসময় ইচ্ছে জাগে, এভাবেই অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে যদি দিন যেতো।

কালো কৃষকের গান----------

দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আর আমার ভেতর
সেখানে বুনবো আমি তিন সারি শুভ্র হাসি, ধৃতপঞ্চইন্দ্রিয়ের
সাক্ষাৎ আনন্দময়ী একগুচ্ছ নারী তারা কুয়াশার মতো ফের একপলক
তাকাবে এবং বোলবে,‘তুমি না হোমার? অন্ধ কবি ছিলে? তবে কেন হলে
চক্ষুষ্মান এমন কৃষক আজ? বলি কী সংবাদ হে মর্মাহত রাজা?
এখানে আঁধার পাওয়া যায়? এখানে কি শিশু নারী কোলাহল আছে?
রূপশালী ধানের ধারণা আছে? এখানে কি মানুষেরা সমিতিতে মালা
পেয়ে খুশী?


গ্রীসের নারীরা খুব সুন্দরের সর্বনাশ ছিলো। তারা কত যে উল্লুক!
ঊরুভুরুশরীর দেখিয়ে এক অস্থির কুমারী কত সুপুরুষ যোদ্ধাকে
তো খেলো!
আমার বুকের কাছে তাদেরও দুঃখ আছে, পূর্বজন্ম পরাজয় আছে
কিন্তু কবি তোমার কিসের দুঃখ? কিসের এ হিরন্ময় কৃষকতা আছে?
মাটির ভিতরে তুমি সুগোপন একটি স্বদেশ রেখে কেন কাঁদো
বৃক্ষ রেখে কেন কাঁদো? বীজ রেখে কেন কাঁদো? কেন তুমি কাঁদো?
নাকি এক অদেখা শিকড় যার শিকড়ত্ব নেই তাকে দেখে তুমি ভীত আজ?
ভীত আজ তোমার মানুষ বৃক্ষশিশু প্রেম নারী আর নগরের নাগরিক ভূমা?

বুঝি তাই দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও তুমি অনাবাদী রাখবে না আর
এম্ফিথিয়েটার থেকে ফিরে এসে উষ্ণ চাষে হারাবে নিজেকে, বলবে
ও জল, ও বৃক্ষ, ও রক্তপাত, রাজনীতি ও নিভৃতি, হরিৎ নিভৃতি
পুনর্বার আমাকে হোমার করো, সুনীতিমূলক এক থরোথরো দুঃখের
জমিন আমি চাষ করি এদেশের অকর্ষিত অমা!

একলা বাতাস

নোখের ভিতর নষ্ট ময়লা,
চোখের ভিতর প্রেম,
চুলের কাছে ফেরার বাতাস
দেখেই শুধালেম,

এখন তুমি কোথায় যাবে?
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে
রক্তে কি প্রব্লেম?

হঠাৎ তাহার ছায়ায় আমি যেদিকে তাকালেম
তাহার শরীর মাড়িয়ে দিয়ে
দিগন্তে দুইচক্ষু নিয়ে
আমার দিকে তাকিয়ে আমি আমাকে শুধালেম

এখন তুমি কোথায় যাবে?
কোন আঘাটার জল ঘোলাবে?
কোন আগুনের স্পর্শ নেবে
রক্তে কি প্রব্লেম?

অপরিচিতি

যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত!

স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়
অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর
ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর
সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত
আমার কেবলই শুধু রাত হয়ে যায়!

Friday, July 1, 2011

প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী

অতো বড় চোখ নিয়ে, অতো বড় খোঁপা নিয়ে
অতো বড় দীর্ঘশ্বাস বুকের নিশ্বাস নিয়ে
যতো তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারশ
যতো তুমি খুলে দাও ঘরের পাহারা
যতো আনো ও-আঙ্গুলে অবৈধ ইশারা
যতো না জাগাও তুমি ফুলের সুরভী
আঁচলে আগলা করো কোমলতা, অন্ধকার
মাটি থেকে মৌনতার ময়ূর নাচাও কোন
আমি ফিরব না আর, আমি কোনদিন
কারো প্রেমিক হবো না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ
আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো।