Wednesday, July 22, 2009

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা

শহীদ কাদরী

ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।

ভয় নেই...আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!


সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।

ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।

ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।

কেন যেতে চাই

শহীদ কাদরী

আমি তোমাদেররই দিকে যেতে চাই
ঝকঝকে নতুন একটি সেতু
যেমন নদীর পাড়ে দাঁড়ানো ঐ লোকগুলোর কাছে পৌছে যেতে চায়
কিন্তু তামা ও পিতলসহ বাসন-কোসন,চিড়ে-গুড় ইত্যাদি গোছাতে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড ব্যস্ত।

মাঝে মাঝে দূর থেকে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তোমাদের ব্যস্ততা দেখতে
ভালবাসি।

সমুদ্র তরঙ্গগুলো সমুদ্রকে নিয়ে এ্যাতো ব্যস্ত নয়,
অরণ্যের অভ্যন্তরে ক্ষুধার্ত,স্বাধীন বাঘ হরিণের জন্য এ্যাতো
ব্যস্ত নয়,
দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রেমিকের হাত ব্রেসিয়ারের ভেতর এ্যাতো
ব্যস্ত নয়,

আমি তোমাদেররই দিকে যেতে চাই
শীতের পর প্রথম উল্টাপাল্টা বাতাস যেমন
প্রত্যেকটি ফাঁক-ফোকর এবং রন্ধ্র দিয়ে যেতে চায় তোমাদের
চোখে-মুখে-চুলে
কিন্তু তৈজসপত্র রঙ,টেবিল চেয়ারের ঢঙ,জানালার পর্দা
ইত্যাদি
বদলাতে,গোছগাছ করতে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড বেশি ব্যস্ত।

ক্বচিৎ-কখনো খুব কাছ থেকে তোমাদের প্রচন্ড ব্যস্ততা আমি দেখি,
দিগন্ত আঁধার-করা সজল শ্রাবণও বৃষ্টি ঝরানোর জন্য
অমন ব্যস্ত নয়,
তাক-করা রাইফেলের অমোঘ রেন্জ থেকে উড়ে পালানোর জন্য
হরিয়ালের ঝাঁকও অমন ব্যস্ত নয়,
কর্কট-রোগীর দেহে ক্যান্সারের কোষগুলো ছড়িয়ে পড়ার জন্য
অমন ব্যস্ত নয়,

আমি তো তোমাদেরই দিকে যেতে চাই
ইন্দ্রনীল একটি মোহন আংটি
প্রেমিকের কম্পমান হাত থেকে প্রেমিকার আঙ্গুলে যেমন
উঠে যেতে চায়,
কিন্তু চাষাবাদ,বানিজ্য এবং প্রতিযোগিতামূলক শিল্প
ইত্যাদি বিষয় নিয়ে
তোমরা ব্যস্ত,বড্ড বেশি ব্যস্ত।

হরিণ-হননকারী ব্যাধের মাংসল মুঠো থেকে ছুটে-যাওয়া
বল্লমের মতো তোমরা ব্যস্ত
দিগভ্রান্ত তৃষ্ণার্ত পথিককে গিলে ফেলার জন্য উত্তর বাংলার
চোরাবালির মতো তোমরা ব্যস্ত
চিরচেনা বৃক্ষরাজিকে পল্লবশূন্য করার জন্য শীতের জটিল
বিস্তারের মতো তোমরা ব্যস্ত
যাত্রী নিয়ে ঘর-ফেরা নৌকাগুলো হরণ করার জন্য চোরাস্রোত
এবং ঘূর্ণিপাকের মতো তোমরা ব্যস্ত

তোমরা ব্যস্ত,তোমরা ব্যস্ত,তোমরা ব্যস্ত
তোমারা বড্ড বেশি ব্যস্ত
অথচ আমি তো আজীবন তোমাদেরই দিকে যেতে চাই।
কেন যেতে চাই!

Tuesday, July 21, 2009

একটি উত্থান-পতনের গল্প

শহীদ কাদরী

আমার বাবা প্রথমে ছিলেন একজন
শিক্ষিত সংস্কৃতিবান সম্পাদক
তারপর হলেন এক
জাঁদরেল অফিসার ;
তিনি স্বপ্নের ভেতর
টাকা নিয়ে লোফালুফি খেলতেন
টাকা নিয়ে ,
আমি তাঁর ছেলে প্রথমে হলাম বেকার ,
তারপর বেল্লিক
তারপরো বেকুব
এখন লিখি কবিতা
আমি স্বপ্নের ভেতর
নক্ষত্র নিয়ে লোফালুফি করি
নক্ষত্র নিয়ে ;
বাবা ছিলেন উজ্জ্বল,ধবধবে ফর্শা
এবং ছয়ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা
আমি তাঁর ছেলে-ময়লা,রোদে-পোড়া,কালো
৫ ফুট ৯ ইঞ্চি মোটে(অর্থাৎ
পাঁচ ইঞ্চি বেঁটে)
বাবা উন্নত-নাসা
পরতেন প্যাঁনসে
আমার নাকই নেই বলতে গেলে
পরি হ্যান্ডেল-অলা চশমা
বাবা জানতেন দুর্দান্ত ইংরিজি
আমি অল্পস্বল্প বাংলা
বাবা যখন-তখন যাকে-তাকে চপেটাঘাত করতে পারতেন ।
আমি কেবল মাঝে-মধ্যে একে-ওকে চুম্বন ছুঁড়ে মারতে পারি ,ব্যাস !
প্রবল বর্ষার দিনে বাবা
রাস্তায় জলোচ্ছ্বাস তুলে স্টুডিবেকারে ঘরে ফিরতেন,
আমি পাতলুন গুটিয়ে স্যান্ডেল হাতে
অনেক খানাখন্দে পা রেখে এভিনিউ পার হ'তে চেষ্টা করি
বাবার নাম খালেদ-ইবনে-আহমাদ কাদরী
যেন দামেস্কে তৈরী কারুকাজ-করা একটি বিশাল ভারী তরবারী,
যেন বৃটিশ আমলের এখনও-নির্ভরযোগ্য কোনো
ঝনঝন ক'রে-ওঠা ওভারব্রীজ ,
আমার নাম খুব হ্রস্ব
আমার নাম শহীদ কাদরী
ছোটো,বেঁটে - ঝোড়ো নদীতে
কাগজের নৌকার মতই পলকা
কাগজের নৌকার মতই পলকা ।

প্রেম

শহীদ কাদরী
We must love one another or die- W.H Auden

না,প্রেম সে কোনো ছিপছিপে নৌকা নয়-
যার চোখ,মুখ,নাক ঠুকরে খাবে
তলোয়ার- মাছের দঙ্গল,সুগভীর জলের জঙ্গলে
সমুদ্রচারীর বাঁকা দাঁতের জন্যে যে উঠেছে বেড়ে,
তাকে,হ্যাঁ,তাকে কেবল জিজ্ঞেস ক'রো,সেই বলবে
না,প্রেম সে কোনো ছিপছিপে নৌকা নয়,
ভেঙে-আসা জাহাজের পাটাতন নয়,দারুচিনি দ্বীপ নয়,
দীপ্র বাহুর সাঁতার নয়; খড়খুটো? তা-ও নয়।
ঝোড়ো রাতে পুরোনো আটাচালার কিংবা প্রবল বৃষ্টিতে
কোনো এক গাড়ি বারান্দার ছাঁট-লাগা আশ্রয়টুকুও নয়,
ফুসফুসের ভেতর যদি পোকা-মাকড় গুন্জন ক'রে ওঠে
না,প্রেম তখন আর শুশ্রূষাও নয়; সর্বদা,সর্বত্র
পরাস্ত সে; মৃত প্রেমিকের ঠান্ডা হাত ধ'রে
সে বড়ো বিহ্বল,হাঁটু ভেঙে- পড়া কাতর মানুষ।
মাথার খুলির মধ্যে যখন গভীর গূঢ় বেদনার
চোরাস্রোত হীরকের ধারালো- ছটার মতো
ব'য়ে যায়,বড়ো তাৎপর্যহীন হ'য়ে ওঠে আমাদের
ঊরুর উত্থান,উদ্যত শিশ্নের লাফ,স্তনের গঠন।

মাঝে মাঝে মনে হয় শীতরাতে শুধু কম্বলের জন্যে,
দুটো চাপাতি এবং সামান্য শব্জীর জন্যে
কিংবা একটু শান্তির আকাঙ্খায়,কেবল স্বস্তির জন্যে
বেদনার অবসান চেয়ে তোমাকে হয়তো কিছু বর্বরের কাছে
অনায়াসে বিক্রি ক'রে দিতে পারি-অবশ্যই পারি।
কিন্তু এখন,এই মুহূর্ত, এই স্বীকারোক্তির পর মনে হলো:
হয়তো বা আমি তা পারি না-হয়তো আমি তা পারবো না।

'সঙ্গতি'

শহীদ কাদরী

বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ।
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না,পাবে না,পাবে না.......

একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুন্জের মতো,
পুরনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না,পাবে না,পাবে না.......

ব্যারাকে ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ
ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,
গামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলি গানের-তোমরা দু'জন একঘরে পাবে ঠাঁই

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না,পাবে না,পাবে না.......

আজ সারাদিন

শহীদ কাদরী

বাতাস আমাকে লম্বা হাত বাড়িয়ে
চুলের ঝুঁটি ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে আজ সারাদিন
কয়েকটা লতাপাতা নিয়ে
বিদঘুটে বাতাস,
হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে আমাকে,
লাল পাগড়ি-পরা পুলিশের মত কৃষ্ণচূড়া
হেঁকে বললো :
'তুমি বন্দী' !

আজ সকাল থেকে একজোড়া শালিক
গোয়েন্দার মতো ঘুরছে
যেন এভিনিউ পার হ'য়ে নির্জন সড়কে
পা রাখলেই আমাকে গ্রেপ্তার ক'রে নিয়ে যাবে ঠিক !

'তুমি অপরাধী'
-এই কথা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যেন
ব'লে গেল বজ্রসহ এক পশলা হঠাৎ বৃষ্টিপাত-
'তুমি অপরাধী'-
মানুষের মুখের আদলে গড়া একটি গোলাপের কাছে।'

বৃষ্টিভেজা একটি কালো কাক
একটি কম্পমান আধ-ভাঙা ডালের ওপর থেকে
কিছুটা কাতর আর কিছুটা কর্কশ গলায়
আবার ব'লে উঠলো: তুমি অপরাধী!

আজ সারাদিন বাতাস,বৃষ্টি আর শালিক
আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো
এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত
তোমার বাড়ির
কিন্নরকন্ঠ নদী অবধি আমি গেলাম
কিন্তু সেখানে ঘাটের উপর একটি প্রাচীন বুড়ি
সোনার ছাই দিয়ে ঘটি-বাটি মেজে চলেছে আপন মনে।
একটা সাংঘাতিক সূক্ষ ধ্বনি শুয়ে আছে
পিরিচে,পেয়ালায়।

ঐ বাজনা শুনতে নেই
ঐ বাজনা নৌকার পাল খুলে নেয়
ঐ বাজনা ষ্টীমারকে ডাঙার ওপর আছড়ে ফ্যালে
ঐ বাজনা গ্রাস করে প্রেম,স্মৃতি,শস্য,শয্যা,ও গৃহ

তোমার বাড়ির
কিন্নরকন্ঠ নদী অবধি আমি গিয়েছিলাম।
কিন্তু হাতভর্তি শালিকের পালক
আর চুলের মধ্যে এলোপাথারি বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে
উল্টোপাল্টা পা ফেলে
তোমার দরজা পর্যন্ত যেতে ইচ্ছে হল না।

ঐ শালিকের ভেতর উনুনের আভা,মশলার ঘ্রাণ।
তোমার চিবুক,রুটি আর লালচে চুলের গন্ধ,
ঐ বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে পাতা আছে তোমার
বারান্দার চেয়ারগুলো
তাহলে তোমার কাছে গিয়ে আর কি হবে!

আজ একজোড়া শালিক
গোয়েন্দা পুলিশের মতো
বাতাস একটা বুনো একরোখা মোষের মতো
আমাকে ধাওয়া করে বেড়ালো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত

আমি অনেকদিন পর একজন হা-ঘরে
উদ্বাস্তু হ'য়ে চরকির মতো গোটা শহর ঘুরে বেড়ালাম।

Sunday, July 19, 2009

দুর থেকে দেখো

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

আমি আমার ভাবনাগুলোকে
চামচে করে নাড়াতে থাকব-
অন্য কোন টেবিল থেকে তুমি শুনো।

সামনে দাঁড় করানো থাকবে কাপ
আমার কোলের ওপর দুটো আঙ্গুল
কুরুশকাঠির মতো বুনবে
স্মৃতির জাল-
তুমি অন্য কোন টেবিল থেকে দেখো।

তারপর
যখন জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে সময়
চেয়ারে শব্দ করে আমি উঠে পড়ব
পেছনে একবারও না তাকিয়ে
আমি চলে যাব
যেখানে বাড়িগুলোর গায়ে
চাবুক মারছে বিদ্যুৎ
যেখানে গাছগুলোকে চুলের মুঠি ধরে
মাটিতে ফেলে দিতে চাইছে হাওয়া
যেখানে বদ্ধ জানালায় নখ আঁচড়াচ্ছে
হিংস্র বৃষ্টি।

তুমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখো।।

পায়ে পায়ে

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সারাক্ষণ
সে আমার পায়ে পায়ে
সারাক্ষণ
পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করে।

তাকে বলি; তোমাকে নিয়ে থাকার
সময় নেই-
হে বিষাদ,তুমি যাও
এখন সময় নেই
তুমি যাও।
গাছের গুঁড়িতে বুক-পিট এক করে
যৌবনে পা দিয়ে রয়েছে
একটি উলঙ্গ মৃত্যু-
আমি এখুনি দেখে আসছি:

পৃথিবীতে গাঁক গাঁক করে ফিরছে
যে দাঁত-খিঁচানো ভয়,
আমি তার গায়ের চামড়াটা
খুলে নিতে চাই।
চেয়ে দেখ হে বিষাদ-
একটু সুখের মুখ দেখবে বলে
আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে
চুল সাদা করে আহাম্মদের মা।

হে বিষাদ,
তুমি আমার হাতের কাছ থেকে সরে যাও
জল আর কাদায় ধান রুইতে হবে।
হে বিষাদ,
হাতের কাছ থেকে সরে যাও
আগাছাগুলো নিড়োতে হবে।

যায় না;
বিষাদ তবু যায় না।
সারাক্ষণ আমার পায়ে পায়ে
সারাক্ষণ
পায়ে পায়ে
ঘুরঘুর করে।

আমি রাগে অন্ধ হই
আমার বেদনাগুলো তার দিকে
ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারি।
বলি : শয়তান,তোকে যমে নিলে
আমি বাঁচি!

তারপর কখন কাজের মধ্যে ডুবে গিয়েছি জানি না-
চেয়ে দেখি
দূরে বসে সেই আমার বিষাদ
আমাকে একেবারে ভুলে গিয়ে
আমার অপূর্ণ বাসনাগুলো নিয়ে খেলছে।

হাসতে হাসতে আমি তাকে
দুরন্ত শিশুর মতো
কোলে তুলে নিই।।

ইলিশ

বুদ্ধদেব বসু

আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।

মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রানপনে ফেলে জাল,টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা,তারা খাদ্যহীন,খাদ্যের সম্বল।

রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে।এলো বর্ষা,ইলিশ -উৎসব।

আগুনের কাছে আগে

পূ্র্ণেন্দু পত্রী

হৃদয়ের কাছে আমি আগে কত গোলাপ চেয়েছি
এখন পাঁউরুটি চাই,সিমেন্টের পারমিট চাই।
সেই রমণীর কাছে আগে কত ভূ-স্বর্গ চেয়েছি
এখন দেশলাই চাই,হাতপাখা,জেলুসিল চাই।

আগুনের কাছে আগে মানুষেরা নতজানু ছিল
মানুষের সর্বোত্তম প্রার্থনার বিস্তীর্নতা ছিল;
আমাকে এমন জামা দাও তুমি,এমন পতাকা
হীরের আংটির মতো মূল্যবান এবং মহান।
আগুনের কাছে এসে এখন মানুষের করজোড়ে
ভোট চায়,কমিটির ডানলোপিলো-আঁটা গদি চায়
মহিষাসুরের নীল খড়গ চায়,অথবা পিস্তল।

মানুষ মেঘের কাছে আগে কত কবিতা চেয়েছে
এখন পেট্রোল চায়,প্রমোশন,পাসপোর্ট চায়।

কেরোসিনে,কখনো ক্রন্দনে

পূর্ণেন্দু পত্রী

জ্যোতির্ময় বিছানা তোমার
তুমি বৃক্ষে শুকাও চাদর
তোমার বালিশ থেকে তুলো
উড়ে আসে আশ্বিনে-অঘ্রাণে।

পশমের লেপ ও তোশক
মসৃণতা ভালোবাসো তুমি
আমাদের নখে বড় ধুলো
মাংসাসীর হাড়-কাঁটা দাঁতে।

তুমি সূর্য ঘোরাও আঙুলে
নক্ষত্র-শাওয়ারে করো স্নান
আমাদের হ্যারিকেন জ্বলে
কেরোসিনে,কখনো ক্রন্দনে।

স্বপ্নগুলি হ্যাঙ্গারে রয়েছে

পূর্ণেন্দু পত্রী

মুহুর্তের সার্থকতা মানুষের কাছে আজ
বড় বেশী প্রিয়।
জীবনের স্থাপত্যের উচ্চতা ও অভিপ্রায়মালা
ছেঁটে ছোট করে দিতে
চতুর্দিকে উগ্র হয়ে রয়েছে সেলুন।
মানুষের ভাঙা-চোরা ভুরুর উপরে
চাঁদের ফালির মতো
আজ কোন স্থির আলো নেই।
ছাতার দোকানে ছাতা যেরকম ঝোলে
সেইভাবে মানুষের রক্ত ও চন্দনমাখা স্বপ্নগুলি
হ্যাঙ্গারে রয়েছে।

Saturday, July 18, 2009

বসন্তকালেই

পূর্ণেন্দু পত্রী

শুনেছি বসন্তকালে বনভূমি অহঙ্কারী হয়।
অথচ আমার সব সোনাদানা চুরি হয়ে গেছে এই বসন্তকালেই।
বসন্তকালেই সেই কপোতাক্ষী রমণীর কুষ্ঠ হয়েছিল
যে আমাকে বলেছিল তার সব নদী,গিরি,অরণ্যের আমি অধীশ্বর।
খুদ-কুঁড়ো খুঁটে খাওয়া গরীবের ছিটেবেড়ো থেকে
তোমাদের মোজাইক বাগান পার্টিতে এসে ফলার খাওয়ার
সর্নিবন্ধ অনুরোধ এসেছিল বসন্তকালেই।

বসন্তকালেই আমি প্রধান অতিথি হয়ে পুরুলিয়া গেছি
বসন্তকালেই আমি ভুবনেশ্বর গিয়ে কবিতা পড়েছি
বসন্তকালেই আমি আকাশের ছেঁড়া জামা সেলাই করেছি।
অথচ আমার সব সোনাদানা,জমি-জমা,কাপড়-চোপড়
স্মৃতি দিয়ে মাজা-ঘষা গোপনতা,অমর পরাগ
এবং বেসরকারী অস্ত্রাগার থেকে লুঠ গোলা ও বারুদ
ভিজে,ভেঙে,গলে,পচে,খসে,ঝরে,নষ্ট হচ্ছে
বসন্তকালেই।