Wednesday, April 29, 2009

সুদর্শনা

জীবনানন্দ দাশ

একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যের লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাড়িয়ে
শুনেছি কিন্নর কন্ঠ দেবদারু গাছ,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে।

সবচেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রা‍‍‍‌‌‌‌‌ত্রি ভালো;
তবুও সময়ে স্থির নয়;
আরেক গভীরতর তোমার বলয়।

এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন
তোমার শরীর; তুমি দান করনি তো;
সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে
সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত ।

আকাশলীনা

জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা এই যুবকের সাথে কথা;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর ।

কী কথা তাহার সাথে ? তার সাথে!
আকাশ আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে ।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস
আকাশের ওপারে আকাশ ।

ঘোড়া

জীবনানন্দ দাশ

আমরা যাইনি মরে আজও - তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন - এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর 'পরে ।

আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে;
চায়ের পেয়ালা ক'টা বেড়ালছানার মতো - ঘুমে - ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে

হিম হয়ে নড়ে গেল ও - পাশের পাইস্ - রেস্তরাঁতে,
প্যারাফিন - লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে ।
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব নিওলিথ - স্তব্ধ তার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।

যাতায়াত

হেলাল হাফিজ

কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।

কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।

নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেউ বলেনি ভাল থেকো সুখেই থেকো
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো।

জন্মাবধি ভেতর থেকে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্স্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।

ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই
দুঃসময়ে এতটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।

কেউ বলেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালবাসি।

ডাকাত

হেলাল হাফিজ

তুমি কে হে?
সোনালী ছনের বাড়ি তছনছ করে রাতে
নির্বিচারে ঢুকে গেলে অন্দর-মহলে
বেগানা পুরুষ, লাজ শরমের মাথা খেয়ে
তুমি কে হে?

তোমাকে তো কখনো দেখিনি আগে এ তল্লাটে
মারী ও মড়কে, ঝড়ে, কাঙ্খিত বিদ্রোহে।
আমাদের যুদ্ধের বছরে
ভিন গেরামের খতো মানুষের পদচারণায়
এ বাড়ি মুখর ছিলো, তোমাকে দেখিনি ত্রি-সীমায়।

চতুর বণিক তুমি আঁধারে নেমেছো এই বানিজ্য ভ্রমণে,
কে জানে কি আছে পাড়া-পড়শীর মনে!
লোভে আর লালসায় অবশেষে আগন্তুক সর্বস্ব হারাবে,
কেন না প্রভাত হলে চারিদিকে মানুষের ঢল নামে যাবে।

সম্প্রদান

হেলাল হাফিজ

ভাদ্রের বর্ধিত আষাঢ়ে সখ্য হয়েছিলো।
সে প্রথম, সে আমার শেষ।

পথে ও প্রান্তরে, ঘরে,
দিনে রাতে, মাসে ও বছরে
সমস্ত সাম্রাজ্য জুড়ে
সে আষাঢ় অতটা ভেজাবে আমি ভাবিনি কসম।

আমার সকল শ্রমে, মেধা ও মননে
নিদারুন নম্র খননে
কি নিপুন ক্ষত দেখো বানিয়েছে চতুর আষাঢ়।

একদিন
সব কিছু
ছিলো তোর
ডাক নামে,
পোড়ামুখী
তবু তোর
ভরলো না মন,-
এই নে হারামজাদী একটা জীবন।

অশ্লীল সভ্যতা

হেলাল হাফিজ

নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না!

হিরনবালা

হেলাল হাফিজ

হিরনবালা তোমার কাছে দারুন ঋণী সারা জীবন
যেমন ঋণী আব্বা এবং মায়ের কাছে।

ফুলের কাছে মৌমাছিরা
বায়ুর কাছে নদীর বুকে জলের খেলা যেমন ঋণী
খোদার কসম হিরনবালা
তোমার কাছে আমিও ঠিক তেমন ঋণী।

তোমার বুকে বুক রেখেছি বলেই আমি পবিত্র আজ
তোমার জলে স্নান করেছি বলেই আমি বিশুদ্ধ আজ
যৌবনে ঐ তৃষ্ণা কাতর লকলকে জিভ
এক নিশীথে কুসুম গরম তোমার মুখে
কিছু সময় ছিল বলেই সভ্য হলো
মোহান্ধ মন এবং জীবন মুক্তি পেলো।

আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর এসেছে,
নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?

আমাকে ভালবাসার পর

হুমায়ুন আজাদ

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।

যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক'রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক'রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ'য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ'য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগন।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ'লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।

আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।

না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।

তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প'ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।

আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।

শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।

Sunday, April 26, 2009

আমার আশ্চর্য ফুল

বিনয় মজুমদার

আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না ক'রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-

আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রানের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো , চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে।

কাগজ কলম নিয়ে

কাগজ কলম নিয়ে
বিনয় মজুমদার

কাগজ কলম নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা প্রয়োজন আজ;
প্রতিটি ব্যর্থতা, ক্লান্তি কি অস্পষ্ট আত্নতৃপ্তি সঙ্গে নিয়ে আসে।
সতত বিশ্বাস হয়, প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু
কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্কস্থাপন করা যায় না এখনো।
সকল ফুলের কাছে এত মহোময় মনে যাবার পরেও
মানুষের কিন্তু মাংসবন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।
বর্ণাবলেগুলি কাছে গেলে অর্থহীন, অতি স্থূল ব'লে মনে হয়।
অথচ আলেখ্যশ্রেণী কিছুটা দূরত্বহেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে।
হে আলেখ্য, অপচয় চিরকাল পৃথিবীতে আছে;
এই যে অমেয় জল-মেঘে মেঘে তনুভূত জল-
এর কতোটুকু আর ফসলের দেহে আসে বলো?
ফসলের ঋতুতে অধিকাংশ শুষে নেয় মাটি।
তবু কি আশ্চর্য, দ্যাখো উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে
তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সংগীতময় হয়।

Wednesday, April 22, 2009

প্রশ্ন

পূর্ণেন্দু পত্রী

ছটাক খানেক বুকে,
একটা গোটা আকাশ এবং
জলের স্থলের গা ভর্তি রং
সব পড়েছে ঝুঁকে।
কাকে কোথায় রাখি?
বুকের মধ্যে হেসে উঠল
শেকল-পরা পাখি।

কেবল আমি হাত বাড়ালেই

পূর্ণেন্দু পত্রী

হাওয়া তোমার আঁচল নিয়ে ধিঙ্গীনাচন করলো খেলা
সকাল বিকেল সন্ধেবেলা
চোখের খিদের আশ মেটালো লম্পটে রোদ রাস্তা ঘাটে
যখন হাঁটো সঙ্গে হাঁটে
বনের পথে হাঁটলে যখন কাঁটাগাছে টানলে কাপড়
চ্যাংড়া ছেঁড়ার ফাজলামিকে ভেবেছিলাম মারবে থাপড়।
একটা নদীর লক্ষটা হাত, ভাসিয়ে দিলে সর্বশরীর
লুটপাটেতে ছিনিয়ে নিলে ওষ্ঠপুটের হাসির জরির
জেল্লাজলুস।
কেবল আমি হাত বাড়ালেই, মাত্র আমার পাঁচটা আঙুল
তোমার মহাভারত কলুষ।

রক্তে মাংসে মনুষ্যজীব, সেই দোষেতেই এমন কাঙাল।
কিন্তু তোমার খবর নিতে আমার কাছেই আসবে ছুটে
অনন্তকাল ।

সিঁড়ি

পূর্ণেন্দু পত্রী

কত রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
সরল সিঁড়ি শীতল সিঁড়ি
পদোন্নতির পিছল সিঁড়ি
অন্ধ এবং বন্ধ সিঁড়ি
কদম ফুলের গন্ধ-সিঁড়ি
ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
কত রকম সিঁড়ির ধাপে কত রকম জল
পা পিছলে অধঃপতন
ভাসতে পারো মাছের মতন
ডুব সাঁতারে মুঠোয় পেলে সঠিক ফলাফল।
কত রকম জলের ভিতর কত রকম মাছ
চুনো পুঁটি রাঘব বোয়াল যার যে রকম নাচ।
পেট চিরলে আংটি কারো
কারো শুধু আঁশ
দীর্ঘতর ফুসফুসে কার দীর্ঘশ্বাস।

সিঁড়ির নীচে জল এবং সিঁড়ির উপর ছাদ
মেঘও পাবে মানিক পাবে
বজ্রধ্বনির খানিক পাবে
পুড়তে চাইলে রোদ
জ্যোৎস্না থেকে চাইতে পার সার্থকতাবোধ।

অনেকরকম সিঁড়ি আছে ওঠা নামা হাঁটার
উর্ধ্বে অভিষেকের তোরণ
নিচের ঝোপটি কাঁটার।

অনেককেই তো অনেক দিলে

পূর্ণেন্দু পত্রী

আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
এর আকাশে ওর আকাশে
ওষ্ঠপুটের অনেক পাখি উড়িয়ে দিলে
পায়রাকে ধান খুঁটতে দিলে খোয়াই জুড়ে
বুকের দুটো পর্দাঢাকা জানলা খুলে
কতজনকে হাত-ডোবানো বৃষ্টি দিলে।
কত মুখের রোদের রেখা মুছিয়ে দিলে নীল কমলে।


আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
চায়ের কাপে মিষ্টি দিলে হাসির থেকে
নকশাকাটা কাঁচের গ্লাসে সরবতে সুখ মিশিয়ে দিলে।
নখের আঁচড় কাটতে দিলে ডালিমবনে
দাঁতের ফাঁকে লাল সুপুরি ভাঙতে দিলে।

আমি ছাড়া অনেককেই তো অনেক দিলে।
একটা জিনিস দাওনি কেবল কাউকে তুমি
আলমারিটার ঝুলন-চাবি।

শূন্যতাকে রঙীন করার সাম্পু সাবান
সায়া শাড়ীর ভাঁজের নিচে
একটা ছোটো কৌটো আছে।
তার ভিতের ভোমরা থাকে।

সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন হাসিতে রক্ত ঝরে ঠিক অবিকল হাসির মতো
সে ভোমরাটি সকল জানে
কোন রুমালে কান্না এবং কোন আঁচলে বুকের ক্ষত
দেয়ালজুড়ে বিকট ছাড়া ভাবছো বুঝি অন্য কারো?
কার ছায়াটি কিরূপ গাঢ় সে ভোমরাটি সকল জানে।

আমার কিছু লিখতে হবে
লিখতে গেলে ভোমরাটি চাই।
তোমার ঘরের আলমারিটার ঝুলন-চাবি
আমায় দেবে?

বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি

পূর্ণেন্দু পত্রী

বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি।
নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুষ্পদল।
নিজের কস্তুরী গন্ধে নিজেই বিহবল।
বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশী বারংবার
আত্নজ কুসুমগুলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলঙ্কৃত করে ওষ্ঠতল।
আমি একা ফুটিতে পারি না
আমি একা ফোটাতে পারি না
রক্তের বিষাদ থেকে আরক্তিম একটি কুসুমও।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো ।

বহু জন্ম বসন্তের অম্লান মন্জরী ফুটে আছো
নয়নের পথে দীর্ঘ ছায়াময় বনবিথীতল
ওষ্ঠের পল্লব জুড়ে পুষ্প বিচ্ছুরণ।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।

তুমি পারো করতলে তুলে নিতে আমার বিষাদ
ভিক্ষাপাত্র ভরে দিতে পারো তুমি অমর-সম্ভারে।
সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আছো চন্দ্রালোকে, চন্দনের ক্ষেত।
আমার উদগত অশ্রু অভ্যর্থনা করে নিতে
পারো না কি তোমার উদ্যানে ?

মোহিনীরা স্বভাবে নির্মম।
আর যারা ভালবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্নার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়।

আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধ

সমুদ্র গুপ্ত

আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধকে আমি
অভিবাদন জানাবো
যিনি আমাকে তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে
দিন দিন শিক্ষিত করে তোলেন, যিনি
তাঁর কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজ
একটি একটি করে খোলেন, আর
আমাকে দেখান
মানুষের কব্জীর যাবতীয় কাজ ও কারুকাজ
তিনি দেখান আর বলেন কোমল স্বরে
শ্রেনীযুদ্ধের ইতিহাসই মানুষের ইতিহাস
আমার চোখের সামনে একেকটি প্রাচীন গুহামুখ
খুলে যায় নিঃশব্দে

বৃদ্ধের দুই চোখ জ্বলে ওঠে
মোমবাতির শিখার মত সাবলীল নরোম আলোয়
আমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
লক্ষ বছর ধরে হেঁটে যাই পা গুণে গুণে
চোখে খোলা তলোয়ারের ঝিলিক
আঙুল জ্যামিতিক কাঁটার মত নির্ভুল, আর
নিঃশ্বাস পিঁপড়ের চেয়েও বে স্পর্শপ্রবণ

প্রত্যেক যাত্রার শেষে সেই সৈম্যবৃদ্ধ বলেন
মানুষের ইতিহাস ক্রমশ এগোয় সম্মুখে
সমৃদ্ধতর এবং বেঁচে থাকার দিকে
আমি স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি, মুহূর্তেই শিখে ফেলি
মানুষের চেতনা যতোই স্বপ্নাবৃত থাক
একদিন এই স্বপ্ন ভাঙবেই
স্বদেশের মানুষেরা ফিরে আসবে মাতৃভূমির স্বাধীনতার দিকে
এবং
রৌদ্রের বিপরীত ঝিলিকে ঝিলিকে উঠবে জীবনের চোখ

আমি
স্বাধীনতার তুমুল লড়াই শেষে
করমর্দন করবো আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধকে
আমি তাঁকে জানাবো অভিবাদন
যাঁর নির্দেশে
রাত্রি শেষের মোরগের মতো ডেকে ওঠে আমার জীবন

প্রতিহিংসা

সমুদ্র গুপ্ত

তোমার দুধের বাটিতে আমি
বেড়ালের সাদা লোম মিশিয়ে দেবো
চোখে ফুঁক দেবো ঢুকিয়ে দেবো ভুরু

পায়ের তালুতে গুল লাগিয়ে
পিঁপড়া লেলিয়ে দেবো
শুকনো চুলের মধ্যে
পাকা খাগড়ার গোটা ছড়িয়ে
ডলে দেবো আচ্ছা মতোন

পাঁজরের একটু উপরে , পিঠের বেকায়দা স্থানে
বিছুটির পাতা ঘষে দেবো
কানের লতির মধ্যে কাঁচা লংকা ভেঙে দেবো

নাভির ওপর শুকনো ধান রেখে
পা দিয়ে ডলে ডলে চাল করবো
তোমার দাম্পত্য ঝগড়ার সময়
হেঁসেলে লবণ ছিটাবো
পাকা ধানে মই দেবো, তোমার
বাড়া ভাতে ছিটিয়ে দেবো ছাই
মনে নেই
তুমি আমার স্বপ্নের বাড়ির উঠানে
দুঃস্বপ্নের কুকুর ছেড়েছ !

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত স্নেহের কথা বলছি
গর্ভবতী বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলছি।
ভালোবাসা দিলে মা মরে যায়
যুদ্ধ আসে ভালোবেসে
মা'য়ের ছেলেরা চলে যায়,
আমি আমার ভাইয়ের কথা বলছি।

যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।

আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।

আমরা কি তা'র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা'র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
তিনি মৃত্তিকার গভীরে
কর্ষণের কথা বলতেন
অবগাহিত ক্ষেত্রে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের কথা বলতেন
সবত্সা গাভীর মত
দুগ্ধবতী শস্যের পরিচর্যার কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।

যে কর্ষণ করে তাঁর প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না
শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।

যখন প্রবঞ্চক ভূস্বামীর প্রচন্ড দাবদাহ
আমাদের শস্যকে বিপর্যস্ত করলো
তখন আমরা শ্রাবণের মেঘের মত
যূথবদ্ধ হলাম।
বর্ষণের স্নিগ্ধ প্রলেপে
মৃত মৃত্তিকাকে সঞ্জীবিত করলাম।
বারিসিক্ত ভূমিতে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করলাম।
সুগঠিত স্বেদবিন্দুর মত
শস্যের সৌকর্য অবলোকন করলাম,
এবং এক অবিশ্বাস্য আঘ্রাণ
আনিঃশ্বাস গ্রহণ করলাম।
তখন বিষসর্প প্রভুগণ
অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করলো
এবং আমরা ঘন সন্নিবিষ্ট তাম্রলিপির মত
রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত হলাম।
তখন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।
দিগন্ত বিদীর্ণ করা বজ্রের উদ্ভাসন কবিতা
রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না
পরভৃতের গ্লানি তাকে ভূলুন্ঠিত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
অভ্যূত্থানের জলোচ্ছ্বাস তাকে নতজানু করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
পলিমাটির সৌরভ তাকে পরিত্যাগ করবে।

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তিনি স্বপ্নের মত সত্য ভাষণের কথা বলতেন
সুপ্রাচীন সংগীতের আশ্চর্য ব্যাপ্তির কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।

যখন কবিকে হত্যা করা হল
তখন আমরা নদী এবং সমুদ্রের মোহনার মত
সৌভ্রত্রে সম্মিলিত হলাম।
প্রজ্জ্বলিত সূর্যের মত অগ্নিগর্ভ হলাম।
ক্ষিপ্রগতি বিদ্যুতের মত
ত্রিভূবন পরিভ্রমণ করলাম।
এবং হিংস্র ঘাতক নতজানু হয়ে
কবিতার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলো।

তখন আমরা দুঃখকে ক্রোধ
এবং ক্রোধকে আনন্দিত করলাম।

নদী এবং সমুদ্রে মোহনার মত
সম্মিলিত কন্ঠস্বর কবিতা
অবদমিত ক্রোধের আনন্দিত উত্সারণ কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে তরঙ্গের সৌহার্দ থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
নিঃসঙ্গ বিষাদ তাকে অভিশপ্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মূক ও বধির থেকে যাবে।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
আমি একগুচ্ছ রক্তজবার কথা বলছি।

আমি জলোচ্ছ্বাসের মত
অভ্যূত্থানের কথা বলছি
উত্‌ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মত
কমলের চোখের কথা বলছি
প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত
সহস্র ক্ষতের কথা বলছি
আমি নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননীর কথা বলছি
আমি বহ্নমান মৃত্যু
এবং স্বাধীনতার কথা বলছি।

যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করলো
তখন আমরা প্রাচীণ সংগীতের মত
ঋজু এবং সংহত হলাম।
পর্বত শৃংগের মত
মহাকাশকে স্পর্শ করলাম।
দিকচক্রবালের মত
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম;
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উত্পাটিত করলাম।

তখন আমরা নক্ষত্রপুঞ্জের মত
উজ্জ্বল এবং প্রশান্ত হলাম।

উত্‌ক্ষিপ্ত নক্ষত্রের প্রস্ফুটিত ক্ষতচিহ্ন কবিতা
স্পর্ধিত মধ্যাহ্নের আলোকিত উম্মোচন কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নীলিমাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মধ্যাহ্নের প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত হতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্ত্রাসের প্রতিহত করতে পারে না।

আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি শ্রমজীবী মানুষের
উদ্বেল অভিযাত্রার কথা বলছি
আদিবাস অরণ্যের
অনার্য সংহতির কথা বলছি
শৃংখলিত বৃক্ষের
উর্দ্ধমুখী অহংকারের কথা বলছি,
আমি অতীত এবং সমকালের কথা বলছি।
শৃংখলিত বৃক্ষের উর্দ্ধমুখী অহংকার কবিতা
আদিবাস অরণ্যের অনার্য সংহতি কবিতা।

যে কবিতা শুনতে জানে না
যূথভ্রষ্ট বিশৃংখলা তাকে বিপর্যস্ত করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
বিভ্রান্ত অবক্ষয় তাকে দৃষ্টিহীন করবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম হীনমন্য থেকে যাবে।

যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন চতুর্দিকে ক্ষুধা।
নিঃসঙ্গ মৃত্তিকা শস্যহীন
ফলবতী বৃক্ষরাজি নিস্ফল
এবং ভাসমান ভূখন্ডের মত
ছিন্নমূল মানুষেরা ক্ষুধার্ত।

যখন আমরা নগরীতে প্রবেশ করলাম
তখন আদিগন্ত বিশৃংখলা।
নিরুদ্দিষ্ট সন্তানের জননী শোকসন্তপ্ত
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ বিভ্রান্ত
এবং রক্তবর্ণ কমলের মত
বিস্ফোরিত নেত্র দৃষ্টিহীন।
তখন আমরা পূর্বপুরুষকে
স্মরণ করলাম।
প্রপিতামহের বীর গাঁথা
স্মরণ করলাম।
আদিবাসী অরণ্য এবং নতজানু শ্বাপদের কথা
স্মরণ করলাম।

তখন আমরা পর্বতের মত অবিচল
এবং ধ্রুবনক্ষত্রের মত স্থির লক্ষ্য হলাম।

আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।

স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।

যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
সে কবি
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
সে কবি
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।

খন্ডযুদ্ধের বিরতিতে
আমরা ভূমি কর্ষণ করেছি।
হত্যা এবং ঘাতকের সংকীর্ণ ছায়াপথে
পরিচ্ছন্ন বীজ বপন করেছি।
এবং প্রবহমান নদীর সুকুমার দাক্ষিণ্যে
শস্যের পরিচর্যা করছি।

আমাদের মুখাবয়ব অসুন্দর
কারণ বিকৃতির প্রতি ঘৃণা
মানুষকে কুশ্রী করে দ্যায়।
আমাদের কণ্ঠস্বর রূঢ়
কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ
কণ্ঠকে কর্কশ করে তোলে।
আমাদের পৃষ্ঠদেশে নাক্ষত্রিক ক্ষতচিহ্ন
কারণ উচ্চারিত শব্দ আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতক
আমাদেরকে বারবার বধ্যভূমিতে উপনীত করেছে।

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমার সন্তানেরা
আমি তোমাদের বলছি।
যেদিন প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ
সূর্যের মত সত্য হবে
সেই ভবিষ্যতের কথা বলছি,
সেই ভবিষ্যতের কবিতার কথা বলছি।

আমি বিষসর্প প্রভুদের
চির প্রয়াণের কথা বলছি
দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের
পরিসমাপ্তির কথা বলছি
সুতীব্র ঘৃণার
চূড়ান্ত অবসানের কথা বলছি।

আমি সুপুরুষ ভালবাসার
সুকণ্ঠ সংগীতের কথা বলছি।

যে কর্ষণ করে
শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।
যে মত্স্য লালন করে
প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।
যে গাভীর পরিচর্যা করে
জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।
যে লৌহখন্ডকে প্রজ্জ্বলিত করে
ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।
দীর্ঘদেহ পুত্রগণ
আমি তোমাদের বলছি।
আমি আমার মায়ের কথা বলছি
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ


আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।

তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।

জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।

আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
আমি আমার মা'য়ের কথা বলছি,
তিনি বলতেন প্রবহমান নদী
যে সাতার জানে না তাকেও ভাসিয়ে রাখে।

যে কবিতা শুনতে জানে না
সে নদীতে ভাসতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মাছের সঙ্গে খেলা করতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে মা'য়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে পারে না
বোনের মৃত্যুর কথা বলছি
ভাইয়ের যুদ্ধের কথা বলছি
আমি আমার ভালবাসার কথা বলছি।
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।

সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।

আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।

সত্যবদ্ধ অভিমান

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়--
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো--
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে....
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান--চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোন মিথ্যে কি মানায় ?

মানুষ

নির্মলেন্দু গুণ

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।


আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তfও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।


আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।


আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।


মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।


আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।

আমার হবেনা, আমি বুঝে গেছি

আবুল হাসান

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
ক্ষমা করবেন বৃক্ষ, আপনার শাখায় আমি সত্য পাখি বসাতে পারবো না !
বানান ভীষণ ভুল হবে আর প্রুফ সংশোধন করা যেহেতু শিখিনি
ভাষায় গলদঃ আমি কি সাহসে লিখবো তবে সত্য পাখি, সচ্চরিত্র ফুল ?

আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই, দেখি
আমার কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল !

উচ্চারণগুলি শোকের

আবুল হাসান

লক্ষি বউটিকে
আমি আজ আর কোথাও দেখিনা,
হাটি হাটি শিশুটিকে
কোথাও দেখিনা,
কতগুলি রাজহাঁস দেখি
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি,
কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখিনা
শিশুটিকে কোথাও দেখিনা !


তবে কি বউটি রাজহাঁস ?
তবে কি শিশুটি আজ
সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ ?


অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো,
শিমুল তুলোর মতো
সোনারূপো ছড়ালো বাতাস ।


ছোটো ভাইটিকে আমি
কোথাও দেখিনা,
নরোম নোলক পরা বোনটিকে
আজ আর কোথাও দেখিনা !


কেবল পতাকা দেখি,
কেল উৎসব দেখি ,
স্বাধীনতা দেখি,

তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পাতাকা ?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব ?